উদারনীতিবাদের মূল বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করো। উদারবাদ ও নয়া উদারবাদ
উদারনীতিবাদের মূল বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করো
‘এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা’ অনুযায়ী উদারনীতিবাদ হল সেই ধারণা যা সরকারের কার্যপদ্ধতি ও নীতি হিসেবে, সমাজ গঠনের নীতি হিসেবে এবং ব্যক্তি ও সমাজের ‘একটি জীবনাদর্শ’ রূপে স্বাধীনতাকে গ্রহণ করে। হবসহাউস-এর মতে উদারনীতিবাদ হল ব্যক্তির আত্মপরিচালনার ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে সমাজ গঠনের বিশ্বাস। সারতোরির ব্যাখ্যায় ব্যক্তি স্বাধীনতা, আইনগত সংরক্ষণ এবং সাংবিধানিক রাষ্ট্রের তত্ত্ব ও অনুশীলনকে উদারনীতিবাদ বলা হয়। সাধারণভাবে এককথায় উদারনীতিবাদ হল যে কোনো ধরণের কর্তৃত্বের নীতির বিরুদ্ধে স্বাধীনতার নীতিকে প্রতিষ্ঠিত করা। এই মতবাদের মূল কথা ব্যক্তি ও তার স্বাধীনতা।
উদারনীতিবাদের মূল বৈশিষ্ট্য গুলি
ব্যক্তি স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য, ব্যক্তির নৈতিক মর্যাদা, মানবিক মূল্যবোধ, রাষ্ট্রীয় সীমাবদ্ধতা, সামাজিক ও রাষ্ট্রনৈতিক সংস্কার প্রভৃতি মৌলিক বিষয়কে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন ধরে সমৃদ্ধ হওয়া মতাদর্শ উদারনীতিবাদের বৈশিষ্ট্যগুলি হল –
- প্রথমত, প্রাচীনত্ব এই মতবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অন্যান্য মতবাদগুলির মধ্যে উদারনীতিবাদ সবচেয়ে পুরানো। সপ্তদশ শতকে জন লকের রচনায় ‘গৌরবময় বিপ্লবের সময়’ উদারনীতিবাদের সূত্রপাত ঘটেছিল।
- দ্বিতীয়ত, বিশেষ সময়ে বিশেষ রূপ গ্রহণের মধ্য দিয়ে উদারবাদের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ষোড়শ শতকে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কার থেকে মানুষকে মুক্ত করার প্রয়াস, সপ্তদশ শতকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দেওয়ার প্রয়াস, অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতকে ন্যায়, যুক্তি, আদর্শকে ভিত্তি করে মানবকল্যাণের প্রয়াস – এই সবের মধ্য দিয়ে উদারবাদের বিকাশ সাধিত হয়। বর্তমানে রাজনৈতিক দলব্যবস্থা, চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলির ভূমিকা, রাষ্ট্রের এক্তিয়ার ও ভূমিকার পরিবর্তন প্রভৃতি উদারবাদকে প্রভাবিত করে।
- তৃতীয়ত, কেবল তত্ত্বের মধ্যে সীমিত না থেকে উদারবাদের প্রয়োগও দেখা যায়। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্ম এই তত্ত্বের প্রায়োগিক দিক।
- চতুর্থত, উদারনীতিবাদ রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রেখে ব্যক্তির স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয়। উভয়ের মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে চায়।
- পঞ্চমত, ব্যক্তির আইনগত পৌর স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয়। প্রত্যেক ব্যক্তি যাতে স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে সেইভাবে আইনভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে চায় এই তত্ত্ব।
- ষষ্ঠত, উদারনীতিবাদ আইন মাফিক কর আরোপের কথা বলে। এই তত্ত্ব অবাধ বাণিজ্য চালু করা, স্থানীয় বা আঞ্চলিক কর ও বাধানিষেধ তুলে দেওয়া, চুক্তির স্বাধীনতা, ব্যবসা বাণিজ্য সংগঠন তৈরির স্বাধীনতাকে সমর্থন করে।
- সপ্তমত, সামাজিক স্তর বিন্যাসের কৃত্রিম বৈষম্য যা ব্যক্তির সামাজিক স্বাধীনতা ভোগের বাধা হয়ে দাঁড়ায় তা বিলোপের স্বপক্ষে মত প্রকাশ করে। জাতপাত, ধর্ম, লিঙ্গ ভিত্তিতে সামাজিক বৈষম্যের অবসান চায় উদারনীতিবাদ।
- অষ্টমত, উদারনৈতিক দর্শনে সবচেয়ে অধিক সংখ্যক লোকের সুখ ও কল্যাণের চিন্তা করা হয়েছে। সপ্তদশ শতকে ইংরেজ হিতবাদী দার্শনিকদের চিন্তায় বহুজনের সুখ ও হিতসাধনের ধারণা প্রকাশ পায় ৷
- নবমত, উদারনীতিবাদী দর্শন মানুষের সুখ ও কল্যাণের লক্ষ্যে রাজনৈতিক আদর্শের সাথে সাথে সাংবিধানিক ও আইনগত সংস্কারের নীতিও ঘোষণা করে। রাষ্ট্রকে রাজনৈতিক চরিত্র প্রদান এবং প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করা উদারনীতিবাদের সাংবিধানিক সংস্কার।
- দশমত, উদারনীতিবাদ প্রতিটি জাতি রাষ্ট্রের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের স্বীকৃতি, রাষ্ট্রগুলির অনাক্রমণ চুক্তি, পরস্পর সহযোগিতার নীতি প্রতিষ্ঠা প্রভৃতির কথা বলে।
পরিশেষে বলা যায় মার্কসবাদীরা উদারনীতিবাদকে বুর্জোয়া শ্রেণির রাষ্ট্রদর্শন বলে উল্লেখ করেন। এছাড়াও উদারবাদ অস্পষ্ট, পরস্পর বিরোধী ও রক্ষণশীল মতবাদ বলেও অনেকে উল্লেখ করেন। তবে বিরুদ্ধ সমালোচনা সত্ত্বেও একথা অনস্বীকার্য যে রাজনৈতিক তত্ত্ব হিসেবে উদারনৈতিক দর্শনের গুরুত্ব ও অবদান অনস্বীকার্য। মানবতাবাদী চিন্তাধারা ও মধ্যযুগীয় চিন্তাধারা থেকে রাষ্ট্র সম্পর্কিত চিন্তাধারা মুক্ত করে উদারনীতিবাদ চলমান সমাজের পরিবর্তনশীলতাকে প্রকাশ করেছে।