অধিকার ও কর্তব্যের সম্পর্ক আলোচনা করো

মৌলিক ধারণা– অধিকার ও কর্তব্যের সম্পর্ক আলোচনা করো অথবা, ‘অধিকারের মধ্যে কর্তব্য নিহিত’ – উক্তিটি বিশ্লেষণ করো।

অধিকার ও কর্তব্যের সম্পর্ক আলোচনা করো অথবা, ‘অধিকারের মধ্যে কর্তব্য নিহিত’ – উক্তিটি বিশ্লেষণ করো

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় অধিকার ও কর্তব্যের ধারণাটি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। অধিকারের আলোচনায় কর্তব্যের প্রসঙ্গ অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে আসে। ব্যক্তি ও সমাজের সামগ্রিক কল্যাণের সঙ্গে অধিকার ও কর্তব্যের দাবি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে। একটিকে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভাবা যায় না। অধ্যাপক ল্যাস্কি বলেছেন যে, অধিকার হল সমাজজীবনের সেই সব শর্ত বা সুযোগ-সুবিধা, যেগুলি ছাড়া মানুষ তার ব্যক্তিত্বের পূর্ণ উপলব্ধি করতে পারে না। দার্শনিক গ্রিনের মতে, অধিকার হল ব্যক্তির উদ্দেশ্যপূরণের ক্ষমতা এবং সমাজ ব্যক্তির ওপর এই ক্ষমতা অর্পণ করে সামগ্রিক সমাজকল্যাণের জন্যে। 

সুতরাং, সমষ্টিগত বা সামগ্রিক কল্যাণবোধের উপলব্ধি থেকে কর্তব্য পালনের প্রশ্নটি এসে যায়। ব্যক্তির পরিবারের প্রতি, সমাজের প্রতি, রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব পালনের কিছু দায়বদ্ধতা রয়েছে। অধিকার কারও একার নয়, সমাজের সকল ব্যক্তির। স্বাভাবিকভাবে প্রত্যেকের ব্যক্তিগত অধিকার অপরের দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে বাস্তবে রূপ লাভ করতে পারে। অধ্যাপক হবহাউস-এর মতে, অধিকার ভোগ সামজিক দায়িত্ব পালনের শর্তাধীন। ব্যক্তির অধিকার ব্যক্তিত্বের সর্বোচ্চ বিকাশ এবং সামাজিক কল্যাণসাধনের সঙ্গে জড়িত। অধ্যাপক ল্যাস্কি বলেছেন, অধিকার বলতে কর্তব্যহীন অধিকার বোঝায় না। কোনো অধিকার সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। ব্যক্তি অন্যের সঙ্গে সমাজকল্যাণের লক্ষ্যপূরণের অংশীদার। তাই একের অধিকার ভোগ অন্যের কর্তব্যপালনের ওপর নির্ভর করে। অধিকার ও কর্তব্যের গভীর সামাজিক সম্পর্ক অস্বীকার করা যায় না।

সমাজের অভ্যন্তরে প্রতিটি মানুষের পরস্পরের ওপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আছে। কোনো ব্যক্তি সমাজস্বার্থ বিরোধী কাজে লিপ্ত হলে তার প্রতিক্রিয়ার অকল্যাণকর দিক অন্যকেও স্পর্শ করে। সুতরাং, ব্যক্তিকে অন্যের স্বার্থের কথা ভেবেই অধিকার প্রয়োগ করতে হয়। অধিকার সমাজকল্যাণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। সমাজকল্যাণ বিরোধী কোনো অধিকার থাকতে পারে না। অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করে ব্যক্তির অধিকার ভোগের সঙ্গে কর্তব্য পালনের প্রশ্ন জড়িয়ে থাকে।

মনে রাখতে হবে যে, অধিকার ব্যক্তিগত নয়, সর্বজনীন। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সকলের অধিকার স্বীকৃত। এই জন্য নিজের অধিকার ভোগের সঙ্গে অন্যের অধিকার ভোগ সুনিশ্চিত করতে হবে। অন্যের অধিকারের প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল না হলে সেও আমার অধিকারকে শ্রদ্ধার চোখে দেখবে না। পরস্পরের অশ্রদ্ধা সমাজের কারও অধিকার ভোগকে নিশ্চিত করবে না; সমাজে নৈরাজ্য দেখা দেবে। মার্কসবাদীরা এই কারণে অধিকার ও কর্তব্যকে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত মনে করেন। সমাজতান্ত্রিক দেশের সংবিধানে অধিকার ও কর্তব্য একই সঙ্গে যুক্ত থাকে।

অন্য একটি দিক থেকে অধিকার ও কর্তব্যের পারস্পরিক সম্পর্ক বিচার করা যায়। অধিকার রাষ্ট্রীয় আইনের দ্বারা স্বীকৃত ও সংরক্ষিত। রাষ্ট্র ওই অধিকার স্বীকার করে বলেই নাগরিকের কর্তব্য পালনের প্রশ্নটি এসে যায়। রাষ্ট্রের দায়িত্ব নাগরিকের অধিকার ভোগের পরিবেশ তৈরি ও সংরক্ষণ করা। স্বাভাবিকভাবে নাগরিকের কর্তব্য হল রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন, কর প্রদান, আইন মান্য করা প্রভৃতি। নাগরিক কর্তব্যপালন না করলে রাষ্ট্রীয় জীবন বিপন্ন হবে। আবার নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। রাষ্ট্র কর্তব্য পালনে শৈথিল্য প্রদর্শন করলে নাগরিকও কর্তব্য পালনে উদাসীন হবে। স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিক অধিকার অস্বীকার করা হয় বলে জনগণ অধিকার রক্ষার জন্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে।

সুতরাং, নাগরিক জীবনের সঙ্গে অধিকার ও কর্তব্যের ধারণা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। অধিকারের মধ্যেই কর্তব্যের ধারণা নিহিত। বুর্জোয়া রাষ্ট্রে আইনের চোখে সকলের সমান অধিকার থাকলেও সকলে সমানভাবে অধিকার ভোগ করতে পারে না। তাছাড়া বুর্জোয়া রাষ্ট্রের সংবিধানে কেবলমাত্র নাগরিক অধিকার লিপিবদ্ধ করা যায়, নাগরিকের কর্তব্য পালনের কথা বলা হয় না। বুর্জোয়া রাষ্ট্রে ধনিক-বণিকশ্রেণির অনেক বেশি অধিকার ভোগের সুযোগ থাকে। কর্তব্য সম্পর্কে সংবিধানে উল্লেখ থাকলে এই বিশেষ শ্রেণির স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয়। সমাজতান্ত্রিক দেশের সংবিধানে অধিকার ও কর্তব্যকে সমান গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করা হয়। সকলের সমান অধিকার যেমন থাকে, সমান দায়িত্ব বা কর্তব্যও থাকে। সুতরাং, অধিকার ও কর্তব্যের ধারণা অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্পর্কযুক্ত।

Leave a Comment