সাম্য বলতে কী বোঝ? সাম্যের প্রকৃতি বিশ্লেষণ কর।মৌলিক ধারণা
সাম্য বলতে কী বোঝ? সাম্যের প্রকৃতি বিশ্লেষণ
প্রাচীন গ্রীসে স্টোয়িক দার্শনিকরা মানুষের স্বাভাবিক সাম্যের কথা বলেন। পরবর্তীকালে রোমান দার্শনিকরাও সাম্যের প্রচার করেন। মধ্যযুগে খ্রিষ্টধর্ম প্রচারকরা মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ অস্বীকার করে সকল মানুষ ঈশ্বরের সৃষ্টি বলে প্রচার করেন। সপ্তদশ শতাব্দীতে টমাস ম্যুর, অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতকে মোরলি, কাবে, সাঁ সিমো, চার্লস ফুরিয়ে, রবার্ট ওয়েন প্রমুখ কাল্পনিক সমাজতন্ত্রীরা সাম্যভিত্তিক আদর্শ সমাজ গঠনের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়ে লক, ভলতেয়ার, রুশো প্রমুখর আলোচনায় সাম্য সম্পর্কিত জোরাল আলোচনা পাওয়া যায়।
আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণা (১৭৭৬), ফরাসী বিপ্লব (১৭৮৯) ‘সাম্য’ এর ঘোষণায় মানুষকে সমান বলে ঘোষণা করা হয়। পরবর্তী সময়ে উনবিংশ শতকে ডাইসি প্রমুখরা আইনগত সাম্যের পক্ষে বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করেন। অন্যদিকে টকভিল, হবস হাউস ও বার্কার প্রমুখরা সামাজিক ও রাজনৈতিক সাম্যের কথা বলেন। ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মার্কসীয় দর্শনে অর্থনৈতিক সাম্যের ধারণা জোরাল ভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
সাম্যের সংজ্ঞা
সাধারণভাবে সাম্য বলতে বোঝায় সকলে সমান। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পুরোপুরি সেই অর্থে ব্যবহার করা যায় না। অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে সাম্য বলতে কোনো ধরনের বিশেষ সুযোগ সুবিধার অনুপস্থিতি এবং সকলের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে সুযোগ সুবিধা প্রদান। এই দৃষ্টিতে সাম্যকে দুটি অর্থে ব্যবহার করা যায়, যথা নেতিবাচক ও ইতিবাচক। নেতিবাচক অর্থে সাম্য বলতে বোঝায় বৈষম্যের অবসান অন্যদিকে ইতিবাচক অর্থে সাম্য বলতে বোঝায় সকলের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সাম্য অর্থে মানুষে মানুষে প্রকৃতিগত বৈষম্যের বিলোপ সাধন নয়, এক্ষেত্রে সাম্য বলতে মানুষে মানুষে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতক বৈষম্য ছাড়াও জাতপাত, মালিক-শ্রমিক বৈষম্যের বিলোপ সাধনকে বোঝায়।
আমেরিকায় সাম্য কথাটি ‘সমান সুযোগ’ অর্থে ব্যবহৃত হয়। ভারতীয় সংবিধানে সাম্য অর্থে, সমান অবস্থায় আইনের চোখে সবাই সমান অর্থে ব্যবহৃত হয়। অবশ্য মার্কসবাদীদের সাম্য ব্যাখ্যার মূল কথা হল প্রত্যেকে সাধ্যমত দেবে এবং প্রয়োজন মতে নেবে এই নীতি কার্যকর করতে পারলে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। মার্কসবাদী ব্যাখ্যায় সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যক্তি সম্পত্তির বিলুপ্তি করে শ্রেণি অবস্থানের বিলোপ সাধন করতে হবে।
সাম্যের প্রকৃতি
এরূপ আলোচনার প্রেক্ষাপটে ‘সাম্য’ ধারণার ‘প্রকৃতি’ আলোচনা করলে বলা যায়।
- প্রথমত, নেতিবাচক অর্থে সাম্য বলতে বোঝায় যখন সমাজে ব্যক্তি মানুষের মধ্যে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ প্রভৃতির ভিত্তিতে বৈষম্য সৃষ্টি করা হয় না। এরূপ ভিত্তিকে বৈষম্য করলে ব্যক্তির সুপ্ত প্রতিভা বিনষ্ট হয়।
- দ্বিতীয়ত, ইতিবাচক অর্থে সাম্য বলতে পর্যাপ্ত পরিমানে সুযোগে সুবিধা প্রদান। ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপযোগী পর্যাপ্ত পরিমানের সুযোগ প্রাপ্তিই সাম্য। এক্ষেত্রে বিভিন্ন মানুষের আত্মবিকাশের সুযোগের দাবি ভিন্ন হতে পারে তবে পর্যাপ্ত পরিমানে পাওয়াটাই সাম্য।
- তৃতীয়ত, মার্কসবাদী অর্থে সাম্যের প্রকৃতি আলোচনায় দেখা যায় সাম্য বলতে বোঝায় সমাজ থেকে শ্রেণি বৈষম্যের অবসান। মার্কসবাদীদের নিকট সাম্য বলতে বোঝায় পুঁজিপতির অবসান, উৎপাদনের উপকরণ সমূহের উপর সামাজিক মালিকানার প্রতিষ্ঠা, সামর্থ্য অনুযায়ী কর্ম সম্পাদন ও সেই অনুযায়ী পারিশ্রমিক প্রাপ্তি।
লেনিনের মতে,
“শোষণ ও শোষিত এবং ভূরিভোজী ও ক্ষুধার্তদের মধ্যে সাম্যকে আমরা কখনোই স্বীকার করি না।”
লেনিন