আইন ও স্বাধীনতার সম্পর্ক ব্যাখ্যা কর। অথবা, “আইনই স্বাধীনতার শর্ত” – ব্যাখ্যা কর। মৌলিক ধারণা
আইন ও স্বাধীনতার সম্পর্ক ব্যাখ্যা কর- অথবা, “আইনই স্বাধীনতার শর্ত” – ব্যাখ্যা কর
আইন ও স্বাধীনতার পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে পরস্পর বিরোধী মতের আলোচনা দেখা যায়। পরস্পর বিরোধী দুটি মতকে ইতিবাচক ও নেতিবাচক এই দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। ইতিবাচক অর্থে যাঁরা মনে করেন আইন ও স্বাধীনতার পরস্পর ঘনিষ্ট সম্পর্ক আছে, একে অপরের পরিপুরক। এই মতের পক্ষে আর্নেস্ট বার্কার, হ্যারল্ড ল্যাস্কি, ডাইসি, হবস হাউস, রিচি প্রমুখর নাম উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে নেতিবাচক অর্থে যাঁরা মনে করেন আইন ও স্বাধীনতা পরস্পর পরিপন্থী। এক্ষেত্রে হার্বাট স্পেনসার, জেরিমি বেন্থাম, জন স্টুয়ার্ট মিল প্রমুখর নাম উল্লেখযোগ্য। অবশ্য তৃতীয় একটি মত লর্ড ব্রাইসির দ্বারা উল্লেখ করা যায়। তিনি আইন ও স্বাধীনতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব দেন। ব্রাইসের মতে “আইন ও স্বাধীনতার মধ্যে কোনো একটির প্রাধান্য দেখা দিলে অপরটি সংকুচিত হয়ে পড়বে।”
ইতিবাচক অর্থে স্বাধীনতা ও আইনের সম্পর্ক আলোচনায় দেখা যায় অবাধ স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর। তাই আইন কর্তৃক ব্যক্তি স্বাধীনতা ভোগের স্বেচ্ছাচারিতা রোধ হওয়া বাঞ্ছনীয়। রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ও আইন ব্যক্তি মানুষের স্বাধীনতা সৃষ্টি ও সুরক্ষিত করবে। তাই বলা হয়, “আইন হল স্বাধীনতার শর্ত। উইলোবির মতে, “নিয়ন্ত্রণ আছে বলে স্বাধীনতা সম্ভব”। হবস হাউসের মতে, “আইন না থাকলে ক্ষমতাবান মুষ্টিমেয় ব্যক্তি স্বাধীনতা ভোগ করার অধিকারী হবে, অপরেরা বঞ্চিত হবে”। ল্যাস্কি উল্লেখ করেছেন, “স্বাধীনতার প্রকৃতিতেই নিয়ন্ত্রণ বর্তমান”। রুশোর মতে, “সব নির্দিষ্ট আইনের প্রতি আনুগত্যই স্বাধীনতা”।
আবার বার্কার মনে করেন, “স্বাধীনতার উৎস হল আইন। আইনের দ্বারা সৃষ্ট ও সংরক্ষিত আইনানুমোদিত স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রিত।” বার্কার উল্লেখ করেন, “প্রত্যেকের স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা প্রত্যেকের স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তার দ্বারা সীমাবদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত।” ফরাসি দার্শনিক রুশো ব্যাখ্যা করেন ব্যক্তির স্বাধীনতা ভোগ সকল মানুষের ‘প্রকৃত ইচ্ছার’ সমন্বয়ে গঠিত “সাধারণ ইচ্ছার” মারফৎ হবে। জার্মান দার্শনিক হেগেল উল্লেখ করেন ব্যক্তি মানুষ প্রকৃত স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবে রাষ্ট্রের প্রতিটি দ্বিধাহীন আনুগত্য প্রদর্শণের মাধ্যমে। উভয়ে পারস্পরিক পরিপূরক কারণ, আইনের শক্তিতে শক্তিশালীদের হাত থেকে দুর্বলদের স্বাধীনতা রক্ষা পায়, আবার শাসকগোষ্ঠী ও নাগরিকদের স্বাধীনতা সহজেই কেড়ে নিতে পারে না, আইনের দ্বারা স্বাধীনতার পরিবেশ সুরক্ষিত হয়। বর্তমান জনকল্যাণ রাষ্ট্রের আইন নাগরিকদের ব্যক্তিত্ব বিকাশের লক্ষ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি ব্যবস্থা করে।
আইন ও স্বাধীনতার সম্পর্ক নেতিবাচক। ব্যক্তি স্বাধীনতা সংরক্ষণে আইন ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের স্বীকার না করাই আইন ও স্বাধীনতার সম্পর্কের নেতিবাচক ব্যাখ্যা। নেতিবাচক অর্থে এই সম্পর্কের ব্যাখ্যা হল স্বাধীনতা কোনো প্রকার নিয়ন্ত্রণের উর্দ্ধে অবস্থান করবে। এই মত অনুযায়ী ব্যক্তিগত কার্যকলাপের উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ বা আইনের নিয়ন্ত্রণ ব্যক্তি স্বাধীনতার পরিপন্থী।
অধ্যাপক ইসাইয়া বার্লিন, ব্রাইসি প্রমুখ ব্যাখ্যা করেন যে উভয়ের সম্পর্কের ব্যাখ্যায় ইতিবাচক অর্থে স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আইনের নিয়ন্ত্রণ বা হস্তক্ষেপকে স্বীকার করা হলেও নেতিবাচক অর্থে এরূপ কোনো নিয়ন্ত্রণকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় নি।
সবশেষে বলা যায় আইন দ্বারা ব্যক্তির স্বাধীনতা পরিবেশ সৃষ্টি ও সুরক্ষিত হয়। অবশ্য মার্কসবাদী ব্যাখায় শ্রেণিবিভক্ত সমাজে রাষ্ট্র বিশেষ শ্রেণির স্বার্থরক্ষার যন্ত্র সেক্ষেত্রে আইন ব্যক্তি স্বাধীনতার সামগ্রিক সুরক্ষার পরিবেশ রক্ষা করতে সক্ষম নয়। বরং মুষ্টিমেয় বিত্তশালীদের স্বার্থ রক্ষায় রাষ্ট্রীয় আইন তৈরি হয়। একমাত্র শ্রেণীহীন সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় মালিকানা থাকা সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় আইন সার্বিক জনগনের স্বাধীনতা সুরক্ষিত করতে সক্ষম হয়।