রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনায় দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি

রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনায় দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ কর।

রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনায় দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ

রাজনীতি চর্চার শুরু থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাক্ষেত্র ও রাজনীতির বিশ্লেষণকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যায়। দৃষ্টিভঙ্গি বলতে বোঝায় আলোচিত বিষয়সমূহ ও তার সাথে সম্পর্কিত তথ্যসমূহ নির্ধারণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত মানদণ্ড। এদিক থেকে বলা যায় দৃষ্টিভঙ্গি বলতে বোঝায় ‘মানদণ্ড নির্ধারণ’। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সামাজিক অগ্রগতি ও ডারউইনের বিবর্তনবাদ, মার্কসের ঐতিসাহিক মতবাদ, ভৌতবিজ্ঞান ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের নতুন নতুন গবেষণা, অনুসন্ধান প্রভৃতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করেছে এবং তার সাথে রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটিয়েছে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা ক্ষেত্রকে কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার বিশ্লেষণ করা হবে তা নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে ভিন্ন মত পরিলক্ষিত হয়।

রাজনৈতিক আলোচনার দৃষ্টিভঙ্গিকে তথ্য ও মূল্যমান সংক্রান্ত সমস্যার ভিত্তিতে দুইভাগে ভাগ করা হয় –

  • (ক) আদর্শ স্থাপনকারী দৃষ্টিভঙ্গি বা মূল্যমান সাপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি এবং
  • (খ) অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি।

কোনো কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী চার ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির কথা উল্লেখ করেছেন –

  • (ক) দার্শনিক,
  • (খ) প্রতিষ্ঠানিক,
  • (গ) আচরণবাদী এবং
  • (ঘ) মার্কসবাদী। 

রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনায় দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি :-

রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনার সম্ভাব্য প্রাচীনতম দৃষ্টিভঙ্গি দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি। দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থকদের মধ্যে প্লেটো, অ্যারিস্টটল, রুশো, কান্ট, হেগেল, গ্রীন, ব্রাডলে বোসাংকে প্রমুখর নাম উল্লেখযোগ্য।

রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনায় দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির বৈশিষ্ট্যসমূহ :-

প্রকৃত পক্ষে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির বক্তাদের আলোচনার প্রেক্ষাপটে এই দৃষ্টিভঙ্গির কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা যায়। যেমন –

  • প্রথমত, এই দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থকরা মনে করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটা আদর্শ আছে। তাই আলোচকরা রাষ্ট্রের বাস্তব অবস্থার আলোচনার তুলনায় আদর্শ রাষ্ট্র, তার বৈশিষ্ট্য, উদ্দেশ্য প্রভৃতি আলোচনায় গুরুত্ব দেয়।
  • দ্বিতীয়ত, এই দৃষ্টিভঙ্গির চিন্তাবিদরা রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনায় ঔচিত্য-অনৌচিত্যের ধারণা পোষণ করেন। 
  • তৃতীয়ত, এই দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থকরা মূলত ভাববাদী ছিলেন। এঁদের মূল লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক জীবনের সামগ্রিক মূল্যবোধ নির্ধারণ করা। যার ভিত্তিতে রাষ্ট্র, সমাজ, নাগরিক, আইন ও অধিকার সম্পর্কিত নীতি নির্ধারিত হবে।
  • চতুর্থত, এই দৃষ্টিভঙ্গির দার্শনিকরা অবরোহী পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। ফলে কোনো সমস্যা অনুসন্ধানে বাস্তবতা বা তথ্য প্রমাণাদির উপর নির্ভর না করে কতকগুলি পূর্বানুমানের উপর নির্ভর করে সর্বজনীন সিদ্ধান্তে উপনীত হন।
  • পঞ্চমত, এই দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির বক্তারা রাজনৈতিক তত্ত্ব ও রাজনৈতিক দর্শনের মধ্যে কোনোরূপ পার্থক্য নিরূপণ করতেন না।

রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনায় দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির ত্রুটিসমূহ :-

এই দৃষ্টিভঙ্গির বক্তব্য সমালোচকদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় নি। সমালোচনকরা বলেন –

  • (১) দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তব সমস্যার বাস্তবসম্মত সমাধানের পথে না গিয়ে আদর্শগত ও নৈতিক পথের সমাধানে গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
  • (২) হবসের লেখনীর মাধ্যমে রাজতন্ত্রকে ন্যায় সঙ্গত প্রতিপন্ন করার প্রয়াস বা লকের লেখায় উদীয়মান মধ্যবিত্তের দাবিসমূহকে সমর্থন করা – এ সব বিষয়গুলি প্রমাণ করে এই দার্শনিকরা পক্ষপাতিত্ব দোষে দুষ্ট ছিলেন।

দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা সত্ত্বে একথা অনেক চিন্তাবিদ বলেন যে, দার্শনিক আলোচনা পুরোপুরি কাল্পনিক ছিল না। এই শ্রেণির চিন্তাবিদরা বরং বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতেন। এই দৃষ্টিভঙ্গির দার্শনিকরা সমকালীন সরকারগুলির পারস্পরিক তুলনামূলক আলোচনা করেন। প্লেটোর দার্শনিক রাজার অনুসন্ধান, অ্যারিস্টটল কর্তৃক ১৫০টি গ্রীক রাষ্ট্রের সংবিধান সংগ্রহ ও তার শ্রেণী বিভাজন, মেকিয়াভেলীর রাজনৈতিক পরামর্শ প্রভৃতি প্রমাণ করে যে, দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রবক্তাগণ কেবল কাল্পনিক আলোচনা করেন নি।

Leave a Comment