রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে ভাববাদী তত্ত্বের মূল্যায়ন

রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে ভাববাদী তত্ত্বের মূল্যায়ন করো। অথবা, রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে আদর্শবাদ অথবা দার্শনিক মতবাদ বা চরম মতবাদের আলোচনা করো।

রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে ভাববাদী তত্ত্বের মূল্যায়ন করো। অথবা, রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে আদর্শবাদ অথবা দার্শনিক মতবাদ বা চরম মতবাদের আলোচনা

ব্যক্তির সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক, ব্যক্তি জীবনে রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা, রাষ্ট্রকে মান্য করার যৌক্তিকতা, প্রভৃতি বিষয়গুলিকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ভিন্ন ভিন্ন তত্ত্ব অবতারণা করেছেন। সমাজতাত্ত্বিকরা রাষ্ট্রকে সামাজিক ধারণা ও সমাজের সংগঠন হিসেবে গণ্য করেন। ইতিহাসবিদরা মনে করেন, মানবসভ্যতার ইতিহাসের এক বিশেষ পর্যায়ে উদ্ভূত রাষ্ট্র একটি মানবিক সংগঠন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের কাছে এটি একটি রাজনৈতিক সংগঠন। আইনবিদদের নিকট রাষ্ট্র আইনের উৎস ও সংরক্ষক। এরূপ প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রের উদ্ভব, প্রকৃতি ও কার্যাবলী সম্পর্কিত আলোচিত বিভিন্নতত্ত্বের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল আদর্শবাদ বা ভাববাদ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ, সমষ্টিবাদ প্রভৃতি।

রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে ভাববাদ বা আদর্শবাদের সংজ্ঞা :-

সাধারণভাবে রাষ্ট্র সম্পর্কিত ভাববাদী তত্ত্ব বলতে বোঝায় যে তত্ত্ব রাষ্ট্রকে কতকগুলি অতিপ্রাকৃত ভাব, মতাদর্শ, আদর্শ, নীতি – নৈতিকতা প্রভৃতির সর্বোৎকৃষ্ট প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। ব্যক্তির নিজস্ব অবস্থানের বিলোপ করে রাষ্ট্রের নিকট নিঃশর্ত আনুগত্য অর্পণের পক্ষপাতীত্ব করে। আদর্শবাদ বা ভাববাদ রাষ্ট্র সম্পর্কিত দার্শনিক মতবাদ, কারো কারো মতে চরম মতবাদ।

রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে ভাবাবাদ বা আদর্শবাদের উৎস :-

প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের আলোচনায় রাষ্ট্র একটি অভিন্ন কল্যাণ, সর্বোৎকৃষ্ট ভাবাদর্শ এবং পরিপূর্ণ চিন্তা ও ভাবনার প্রতীক। পরবর্তী সময়ে জার্মান দার্শনিক কান্ট, হেগেল, ফিকটে, ইংরেজ দার্শনিক গ্রিন, ব্রাডলে, বোসাংকে প্রমুখের আলোচনায় আদর্শবাদ বা ভাববাদের তত্ত্বটি বলিষ্ঠতা অর্জন করে।

ভাববাদী রাষ্ট্রীয় তত্ত্বের মৌলিক বিষয় :-

ভাবাবাদ বা আদর্শবাদের রাষ্ট্র সম্পর্কিত আলোচনার মৌলিক বিষয় গুলি হল –

  • প্রথমত, ভাববাদীদের মতে মানুষের সমাজবদ্ধ জীবন অতিবাহিত করার প্রয়াস সহজাত। তাই গঠিত হয় পরিবার এবং পরিবারের আয়তন বৃদ্ধি পথ ধরে কয়েকটি পরিবার মিলিত হয়ে তৈরি করে একটি বৃহৎ সঙ্ঘ। এই বৃহৎ সঙঘই আরো বড় আকারে রাষ্ট্রে পরিণত হয়। হেগেলের মতে, “রাষ্ট্রে উদ্ভবের এই বিবর্তন হল অনন্ত সত্ত্বার বিবর্তন”।
  • দ্বিতীয়ত, এই মতবাদ অনুযায়ী রাষ্ট্র নৈতিকতার মূর্ত প্রতীক। এটি নৈতিক প্রতিষ্ঠান। নাগরিকদের নৈতিকতা, আদর্শ, মূল্যবোধ প্রভৃতি এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে। 
  • তৃতীয়ত, ভাববাদীদের মতে রাষ্ট্র ব্যক্তি মানুষের অপরিহার্য ও চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্র ব্যতীত ব্যক্তির পরিপূর্ণ জীবন ও আত্মোপলব্ধি সম্ভব নয়। রাষ্ট্রের আদর্শই চরম চূড়ান্ত ও অভ্রান্ত। তাই ব্যক্তি স্বাধীনতার সংরক্ষক হল রাষ্ট্র। হেগেলের মতে নিয়ম শৃঙ্খলা বিহীন প্রাকৃতিক পরিবেশ ত্যাগ করে সমাজে প্রবেশের আগে মানুষ যে স্বাধীনতা ভোগ করত সমাজের সদস্য হিসেবে তার চেয়ে অনেক বাস্তব ও প্রকৃত স্বাধীনতা সে ভোগ করে।
  • চতুর্থত, এই মতবাদের সমর্থকরা উল্লেখ করেন রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ঈশ্বরের নিকট থেকে প্রাপ্ত রাষ্ট্র ঐশ্বরিক গুণ সম্পন্ন পবিত্র সংগঠন। হেগেল রাষ্ট্রকে ‘মর্তভূমিতে ঈশ্বরের পদক্ষেপ’ বলে উল্লেখ করেছেন। গ্রিন রাষ্ট্রের মধ্যে ‘শাশ্বত চেতনা’ খুঁজে পান এবং সকলকে তা মান্য করতে বলেন।
  • পঞ্চমত, ভাববাদীতত্ত্ব রাষ্ট্রের কর্তৃত্ববাদী তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করে। এটিকে অতি মানবীয় সংগঠন হিসেবে বিবেচিত করা হয়। সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উর্ধে এর অবস্থান। এই তত্ত্ব অনুযায়ী রাষ্ট্র সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী। রাষ্ট্রত্বের নূন্যতা নয়, আধিক্যই ভাববাদীদের কাছে কাম্য।
  • ষষ্ঠত, ভাববাদীদের নিকট রাষ্ট্র ও সমাজ অভিন্ন। ভাববাদী তত্ত্বে রাষ্ট্রের মধ্যে ব্যক্তি পরিবার, সমাজ, ব্যক্তি স্বাধীনতা, নৈতিকতা সকল কিছুই বিলীন হয়ে গেছে। সমাজ বনাম রাষ্ট্র বা ব্যক্তি বনাম রাষ্ট্র এরূপ ধারণা ভাববাদী ব্যাখ্যায় নেই।
  • সপ্তমত, এই মতবাদ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের বিরোধী। ব্যক্তির স্বাধীনতা স্বীকার করলেও তা কখনোই রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার উর্ধ্বে নয়। গ্রীনের ন্যায় ভাববাদীরা ব্যক্তি স্বাধীনতার পৃষ্ঠপোষকতা করবে তবে সামাজিক ও অখণ্ড কল্যাণের বাইরে ব্যক্তির স্বতন্ত্র কোনো অস্থিত্ব স্বীকার করেন নি।

রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে ভাববাদের সীমাবদ্ধতা :-

বিভিন্ন দিক থেকে ভাববাদী বিশ্লেষণের বিরুদ্ধে সমালোচনা করা হয়। যেমন – 

  • প্রথমত, ভাববাদী তত্ত্বের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হল এই মতবাদ বাস্তব উপাদানকে স্বীকৃতি না দিয়ে কেবল কল্পনা ও ভাবের জগতে থেকে রাষ্ট্রের ব্যাখ্যা করে। বার্কার উল্লেখ করছেন, “ভাববাদে যে রাষ্ট্রের কল্পনা করা হয় স্বর্গরাজ্যে তা সম্ভব হতে পারে, কিন্তু মাটির পৃথিবীতে তা প্রতিষ্ঠিত হয়নি”।
  • দ্বিতীয়ত, এই তত্ত্বের সমালোচকদের মতে রাষ্ট্র সর্বশক্তিমান এবং সকল ব্যক্তি রাষ্ট্রের প্রতি নিঃশর্তে আনুগত্য দেবে – এরূপ বক্তব্য সমর্থন যোগ্য নয়। কারণ এতে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বেসরকারি সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলিও যে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের সহায়ক তা অস্বীকার করা হয়।
  • তৃতীয়ত, ভাববাদীরা রাষ্ট্র ও সমাজ অভিন্ন বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু সমালোচকরা উল্লেখ করেন সমাজ অনেক ব্যাপক। রাষ্ট্রের কাজের বাইরে সমাজের সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় প্রভৃতি কাজকর্ম ব্যক্তির সর্বাঙ্গীণ বিকাশে সহায়ক।
  • চতুর্থত, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের পরিপন্থী মত ব্যাখ্যা করে ব্যক্তিকে শর্তহীন আনুগত্য প্রদানের কথা বলেছেন ভাববাদীরা। রাষ্ট্রের কল্যাণ হলে ব্যক্তির কল্যাণ হবে, রাষ্ট্রের জন্য ব্যক্তি এরূপ ধারণা যথার্থ নয়। সমালোচকদের মতে মানুষের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে।
  • পঞ্চমত, কোনো কোনো সমালোচকের মতে, এই মতবাদ রক্ষণশীলতা দোষে দুষ্ট এবং প্রগতি বিরোধী একটি বিপজ্জনক মতবাদ। ফিকটে, ট্রিটসকে প্রমুখের ন্যায় ভাববাদীরা সাম্রাজ্যবাদ ও যুদ্ধবাদের ন্যায় বিপজ্জনক মতবাদের জন্ম দিয়েছেন।

রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে ভাববাদী বা আদর্শবাদ তত্ত্বের মূল্যায়ন

সবশেষে বলা যায়, সমালোচনা সত্ত্বেও দার্শনিক দিক থেকে বিচার করলে এই মতবাদের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ভাববাদকে বাস্তব বর্জিত অসারতত্ত্ব হিসেবে সমালোচনা করলেও তৎকালীন সমাজের প্রেক্ষাপটেই এই মতবাদের জন্ম। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে নিটশে, ফিকটে, ট্রিটসকে প্রমুখ ভাববাদীদের ব্যাখ্যায় এই মতবাদ যেমন বিকৃতরূপ পায় তেমনি গ্রিনের ন্যায় ভাববাদী যখন উল্লেখ করছেন নাগরিকদের অধিকার রক্ষা করেই রাষ্ট্র কেবল আনুগত্য দাবি করতে পারে – তখন নিঃসন্দেহে বলা যায় এরূপ যৌক্তিক ব্যাখ্যা অনস্বীকার্য।

Leave a Comment