রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি

রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা কর। অথবা, টীকা লেখ : রাষ্ট্রের অবলুপ্তি। অথবা, শ্রেণী শোষণের যন্ত্র হিসেবে রাষ্ট্রের প্রকৃতি আলোচনা কর। অথবা, রাষ্ট্রের উৎপত্তির বিষয়টিকে মার্কসবাদীরা কীভাবে ব্যাখ্যা করেন? 

রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা – টীকা লেখ : রাষ্ট্রের অবলুপ্তি – শ্রেণী শোষণের যন্ত্র হিসেবে রাষ্ট্রের প্রকৃতি আলোচনা – রাষ্ট্রের উৎপত্তির বিষয়টিকে মার্কসবাদীরা কীভাবে ব্যাখ্যা করেন? 

  • রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা কর।
  • অথবা, টীকা লেখ : রাষ্ট্রের অবলুপ্তি।
  • অথবা, শ্রেণী শোষণের যন্ত্র হিসেবে রাষ্ট্রের প্রকৃতি আলোচনা কর।
  • অথবা, রাষ্ট্রের উৎপত্তির বিষয়টিকে মার্কসবাদীরা কীভাবে ব্যাখ্যা করেন? 

রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি

রাষ্ট্রের উদ্ভব, তার প্রকৃতি, কার্যাবলী, নাগরিকদের সাথে পারস্পরিক সম্পর্ক প্রভৃতি বিষয়কে নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে বহুকাল আগে থেকেই আলোচনা পরিলক্ষিত হয়। প্রাচীন ভারতের কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, মহাভারতের শান্তিপর্ব, প্রাচীন গ্রীসের দার্শনিকদের দ্বারাও রাষ্ট্র সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশ্নের অনুসন্ধান করতে দেখা যায়। আবার মধ্যযুগের দার্শনিক, যেমন – সেন্ট অগাস্টিন, সেন্ট টমাস অ্যাকুইনাস প্রমুখের রচনায় এই বিষয়ে অনুসন্ধিৎসা পরিলক্ষিত হয়।

আধুনিক যুগের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, যেমন – টমাস হবস, জন লক, রুশো, হেগেল প্রমুখ তাত্ত্বিকও এরূপ প্রশ্নের উত্তর অন্বেষণ করেন। এরূপ প্রেক্ষাপটে মার্কসীয় মতবাদ বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

লেনিনের মতে,

“Marxism is the system of the views and teaching of Marx”.

এমিল বার্নস উল্লেখ করছেন,

“মার্কসবাদ হল আমাদের জগৎ ও তারই অংশ মানবসমাজ সম্পর্কে সাধারণ তত্ত্ব।”

তাই রাষ্ট্র সম্পর্কিত মার্কসবাদী ধারণা একাধিক উৎস থেকে সংগ্রহ করতে হয়। বিশেষ করে কার্ল মার্কসের ‘দাস ক্যাপিটাল’, ‘ফ্রান্সের শ্রেণিসংগ্রাম’, ‘লুই বোনাপার্টের অষ্টম ব্রুমেয়ার’, ‘দি জার্মান আইডোলজি’, এঙ্গেলসের লেখা ‘পরিবার, পৌরসমাজ ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’, ‘অ্যান্টি ডুরিং’, লেনিনের লেখা ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’, ‘রাষ্ট্র’, এবং মার্কস ও এঙ্গেলসের লেখা ‘কমিউনিষ্ট ম্যানিফেস্টো’ নামক গ্ৰন্থ থেকে রাষ্ট্র সম্পর্কিত ধারণা পাওয়া যায়।

এঙ্গেলসের মতে,

“আদিম সাম্যবাদী সমাজে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ছিল না। এমন সমাজও ছিল যেগুলি রাষ্ট্র ব্যতীত চলত, এমনকি রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা ছিল না। অর্থনৈতিক বিকাশের একটি বিশেষ স্তরে যখন অনিবার্যভাবে সমাজে শ্রেণিবিভাগ এল, তখনই রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা দেখা যায়।”

লেনিনের মতে,

“ইতিহাসে দেখা যায় যখনই এবং যেখানেই সমাজের শ্রেণী বিভাগ দেখা দিল অর্থাৎ সমাজ এমন কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে পড়ল যাদের মধ্যে কেউ চিরকাল অন্যদের শ্রমের ফল হস্তগত করার মতো অবস্থানে থাকছে, যেখানে কিছুকাল অন্যদের শোষণ করছে, তখনই সেখানে মানুষের প্রতি বলপ্রয়োগের বিশেষ যন্ত্র হিসেবে রাষ্ট্রের উদ্ভব দেখা দিল”।

লেনিনের মতে রাষ্ট্র হল একটি শ্রেণীর উপর অন্য একটি শ্রেণীর আধিপত্য বজায় রাখার লড়াই। মার্কস উল্লেখ করেন রাষ্ট্র একটি প্রশাসনিক ক্ষমতা যা আমলাতন্ত্র ও সামরিক বাহিনী নিয়ে গঠিত। মার্কসবাদ অনুযায়ী শ্রেণী বিভক্ত সমাজে আইন, বিচার ও শাসন বিভাগ হল বুর্জোয়া রাষ্ট্রের আসল প্রতীক। ক্ষমতাবান শ্রেণির বা উৎপাদিকা শক্তির মালিক পক্ষের স্বার্থ রক্ষাই রাষ্ট্রের মূল কাজ। মার্কস ও এঙ্গেলস কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে উল্লেখ করছেন আধুনিক রাষ্ট্রের শাসন বিভাগ হল সমগ্র বুর্জোয়াদের সাধারণ কাজকর্ম পরিচালনার কমিটি। মার্কসবাদীরা উল্লেখ করেন রাষ্ট্র নামকরণে গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রই হোক বা নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রই হোক বা একনায়কতন্ত্রই হোক যে রাষ্ট্রে পুঁজির আধিপত্য থাকবে তাতে রাষ্ট্র হল শ্রমিক ও দরিদ্রের উপর পুঁজিপতিদের আধিপত্য বজায় রাখার যন্ত্রমাত্র। 

লেনিনের মতে সার্বজনীন ভোটাধিকার, সংবিধান সভা, পার্লামেন্ট প্রভৃতি হল বুর্জোয়া রাষ্ট্রের বাহ্যিক প্রকাশ। ঐতিহাসিক বস্তুবাদ অনুযায়ী ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে শ্রেণীবিভাজিত সমাজে রাষ্ট্রের প্রকৃতি আলোচিত হয়। সমাজের শ্রেণীবিভাজনে দেখা যায় শ্রেণীহীন আদিম সাম্যবাদী সমাজের পর দাস সমাজ (দাস ও দাসমালিক দুটি শ্রেণী), পরবর্তী পর্যায়ে সামন্ত সমাজ (সামন্ত ও সামন্তপ্রভু), সামন্ততান্ত্রিক সমাজের অবসানে দেখা দিল পুঁজিবাদী সমাজ (পুঁজিপতি ও প্রলেতারিয়েত)। মার্কসবাদীদের মতে আদিম সাম্যবাদী সমাজে যেহেতু উৎপাদনকেন্দ্রিক কোনো শ্রেণীবিভাজন ছিল না তাই রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা ছিল না। মার্কস উল্লেখ করেন শ্রেণী বিভাজন না থাকায় শ্রেণীশোষণ ও শ্রেণী শাসনের অস্তিত্ব ছিল না। তাই শ্রেণী শোষণের হাতিয়ার যন্ত্র হিসেবে রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা ছিল না। কিন্তু বুর্জোয়া বা ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় শ্রেণিসংগ্রাম এবং শ্রেণি-বিভাজন নতুন রূপ পরিগ্রহ করে।

বুর্জোয়া সমাজের মধ্যেই উদ্ভব হয়েছে সেই সমাজের সমাধিখনকদের। বুর্জোয়া সমাজে শোষণের কোনো অবসান ঘটে না এবং শ্রেণিদ্বন্দ্বও চরম আকার ধারণ করে। বুর্জোয়া ও সর্বহারার এক মরণপণ সংগ্রামে সর্বহারার জয়লাভ অপরিহার্য বলে মার্কস ও এঙ্গেলস ঘোষণা করেছেন। ধনতান্ত্রিক বা বুর্জোয়া সমাজের অন্তর্দ্বন্দ্ব চরম সংকট সৃষ্টি করে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে সর্বহারা শ্রেণি কৃষক ও জনগণের ব্যাপক অংশের সমর্থনে সর্বহারার বিপ্লবের মাধ্যমে শাসন ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হয়। বুর্জোয়া রাষ্ট্রের উচ্ছেদসাধনের মধ্য দিয়ে সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। সর্বহারার বিপ্লবের মাধ্যমে বুর্জোয়া রাষ্ট্র ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং তার স্থান অধিকার করে সর্বহারার একনায়কত্ব।

বুর্জোয়া রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হলেও রাষ্ট্র থাকবে এবং এই রাষ্ট্র হবে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় উৎপাদনের উপকরণের ওপর সামাজিক মালিকানা এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতার সম্পর্ক স্থাপিত হবে। রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ, স্বাধীনতা ও সাম্য, শ্রেণীবৈষম্য ও শ্রেণিদ্বন্দ্ব থেকে মুক্ত সমাজের রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত ঐক্যই হবে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মৌলিক বৈশিষ্ট্য। এর লক্ষ্য হবে শ্রেণীহীন শোষণহীন সমাজব্যবস্থার প্রবর্তন।

রাষ্ট্রের অবলুপ্তি :-

মার্কস ও এঙ্গেলসের কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতেই প্রথম রাষ্ট্রের অবলুপ্তির কথা পাওয়া যায়। প্রলেতারিয়েত একনায়কতন্ত্রের কাজ হল পুঁজিবাদী ব্যক্তি মালিকানার বিলোপসাধন, দেশের সম্পত্তিকে জনগণের হাতে অর্পণ, জনগণকে রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার প্রদান, শ্রেণীগত শোষণ অবসান, বিপ্লবের শত্রুদের প্রতিরোধ করা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিকাশ সাধন, সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের পরিবেশ তৈরি করা, নারী জাতির পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠা, প্রভৃতির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক আধিপত্য বিলুপ্ত হবে। বিকাশের গতিপথে শ্রেণী ও শ্রেণী বিরোধের সমাজ অবলুপ্ত হয়ে তৈরি হবে এক সমিতি যার মধ্যে প্রত্যেকের স্বাধীন বিকাশ হবে সকলের স্বাধীন বিকাশের শর্ত। 

এঙ্গেলস ‘অ্যান্টি ড্যুরিং’ গ্রন্থে রাষ্ট্রের অবলুপ্তির ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন আজকের দিনের শক্তিশালী উৎপাদন ব্যবস্থাকে অনুধাবন করতে তার সামাজিক রূপটি জানলে এই উৎপাদন পদ্ধতি ও এর সমর্থকদের বিরোধিতা করা যায়। পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতিই জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে প্রলেতারিয়েতে রুপান্তরিত করে। এই প্রলেতারিয়েত রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে উৎপাদন শক্তিকে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিতে পরিণত করে। সকল প্রকার শ্রেণির বৈরীতা দূর করে নিজে প্রলেতারিয়েত হিসেবে বিলীন হয় এবং রাষ্ট্রকে অবলুপ্ত করে। বিভেদ, শোষণ, দারিদ্র্যের মূল কারণই যখন অবলুপ্ত হচ্ছে তখন রাষ্ট্রও অবলুপ্ত হবে।

রাষ্ট্র সম্পর্কিত মার্কসীয় তত্ত্বের সমালোচনা

রাষ্ট্র সম্পর্কিত বিভিন্ন তত্ত্বগুলির মধ্যে মার্কসীয় তত্ত্ব এক আলোড়ন সৃষ্টিকারী বিশেষ তত্ত্ব হলেও সমালোচকদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় নি। বিভিন্ন ভাবে এই মতবাদের সমালোচনা করা হয়। যেমন –

  • প্রথমত, মার্কসবাদ সমাজের ইতিহাস ব্যাখ্যার অর্থনৈতিক উপাদানের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। কিন্তু ধর্ম, আদর্শ, ন্যায় নীতি, প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না।
  • দ্বিতীয়ত, সমালোচকদের মতে মার্কসবাদীরা কেবল শ্রেণী সংগ্রামের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁদের মতে শ্রেণি বিভাজনের ফলে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা রাষ্ট্রের উৎপত্তির একটি কারণ হলেও একমাত্র কারণ নয়। 
  • তৃতীয়ত, ‘রাষ্ট্র নিপীড়নের যন্ত্র’, ‘রাষ্ট্র বুর্জোয়াদের স্বার্থরক্ষার যন্ত্র’ – এরূপ উক্তির দ্বারা রাষ্ট্রের সকল কাজে রাষ্ট্রের নিপীড়নমূলক ভূমিকার প্রতি অধিক গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রের কল্যাণমূলক ও নিরপেক্ষ ভূমিকাও থাকতে পারে তা অস্বীকার করা হয়েছে।
  • চতুর্থত, রাষ্ট্রের অবলুপ্তি সংক্রান্ত মতবাদও সমালোচকরা স্বীকার করেন না। তাঁদের মতে শ্রেণীহীন সাম্যবাদী সমাজ কল্পনা বিলাপ মাত্র।
  • পঞ্চমত, মার্কসবাদীরা মার্কসীয় তত্ত্বকে শাশ্বত, চিরন্তন ও অভ্রান্ত বলে ঘোষণা করলেও তা সত্য নয়। নিত্য নূতন পরিবর্তনের সাথে সাথে মতদর্শের পরিবর্তন সাধিত হয়।

পরিশেষে সমালোচনা সত্ত্বেও বলা যায় মার্কসবাদীরা মানব সমাজের অগ্রগতির ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা দিয়ে কতকগুলি সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। এছাড়া শ্রেণীসংগ্রামের তত্ত্ব বর্তমানে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। বস্তুনিষ্ঠ, বিজ্ঞানভিত্তিক ও মানবিক মতবাদ হিসেবে মার্কসবাদ গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।

Leave a Comment