আধুনিক রাষ্ট্র সম্পর্কে গান্ধিজির ধারণাটির মূল্যায়ন করো।
আধুনিক রাষ্ট্র সম্পর্কে গান্ধিজির ধারণাটির মূল্যায়ন
গান্ধিজি মূলত কোনো বিশেষ রাজনৈতিক তত্ত্ব বা দর্শন তত্ত্বের সূত্রপাত করেন নি। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও নৈতিক জীবনের সমস্যা সম্পর্কে তাঁর ধ্যান-ধারণাই রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে প্রসারিত হয়েছে। তাঁর রাষ্ট্র সম্পর্কিত চিন্তাকে ঐতিহাসিক বিচারে মৌলিক বলে গণ্য করা যায় না। বিভিন্ন চিত্তানায়কের আদর্শ ও লক্ষ্যকে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বিচারে নতুন করে প্রয়োগ করবার ক্ষেত্রেই গান্ধিজি বিশেষ কৃতিত্বের অধিকারী। রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে গান্ধিজি টলস্টয়ের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হন। ডেভিড থরোর চিন্তার কিছু প্রভাবও রাষ্ট্র সম্পর্কে গান্ধিজির ধারণার মধ্যে লক্ষ করা যায়।
গান্ধিজির রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তার সঙ্গে পশ্চিমী রাষ্ট্রতত্ত্বের মিল খুঁজতে অনেক লেখক তাঁর চিন্তাধারাকে নৈরাজ্যবাদী দর্শনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। অধ্যাপক বিনয় সরকার গান্ধিজিকে নৈরাজ্যবাদী দার্শনিক বলে অভিহিত করেন। রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্ব এবং বলপ্রয়োগ ভূমিকার জন্যই রাষ্ট্র সম্পর্কে গান্ধিজি বিরূপ ধারণা পোষণ করেছেন। ডেভিড থরোর মত অনুসরণে তিনি বলেছেন যে, শাসনমুক্ত শাসনব্যবস্থাই শ্রেষ্ঠ। কিন্তু অনেক লেখক গান্ধিজিকে নৈরাজ্যবাদী বলতে চান না। নৈরাজ্য দর্শনের প্রবণতা তাঁর রাজনৈতিক চিন্তায় পরিলক্ষিত হলেও এই বিষয়ে তাঁর কোনো গোঁড়ামি ছিল না।
গান্ধিজির অহিংস নীতির ওপর গভীর আস্থা
গান্ধিজির অহিংস নীতির ওপর গভীর আস্থা এবং পশুবলের প্রতি অশ্রদ্ধা রাষ্ট্র সম্পর্কে তার ধারণার মধ্যে সুপরিস্ফুট। রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্ব ও তার অশুভ প্রভাব সম্পর্কে গান্ধিজি বিশেষ অবহিত ছিলেন। তাঁর মতে, “রাষ্ট্র হল কেন্দ্রীভূত ও সুসংবদ্ধ হিংসা বা বলপ্রয়োগমূলক প্রতিষ্ঠান। ব্যক্তি মানুষের একটি আত্মা রয়েছে, কিন্তু রাষ্ট্র হল আত্মাবিহীন একটি যন্ত্র, যা সহিংস বলপ্রয়োগ ছাড়া বাঁচতে পারে না।” গান্ধিজি সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, রাষ্ট্রের ক্ষমতা বৃদ্ধি মঙ্গলের পরিবর্তে অমঙ্গল বা অকল্যাণকেই আহ্বান করে আনে। সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রে শোষণের অবসান ঘটাতে সমর্থ হলেও ব্যক্তিত্বের বিনাশ সাধন হবে। এই ব্যক্তিত্বই সমাজ প্রগতির মূল কারণ।
জনগণের জীবনের ব্যাপক কল্যাণসাধনের মাধ্যম বা উপায়
রাষ্ট্রকে গান্ধিজি উদ্দেশ্য হিসেবে চিহ্নিত না করে জনগণের জীবনের ব্যাপক কল্যাণসাধনের মাধ্যম বা উপায় হিসেবে স্বীকার করেন। রাষ্ট্রকে পবিত্র প্রতিষ্ঠান মনে করবার কোনো কারণ নেই। মানুষের জীবনের অসম্পূর্ণতা বা দুর্বলতার জন্যই রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি। রাষ্ট্র যেহেতু কল্যাণসাধনের মাধ্যম, সেহেতু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপপ্রয়োগে ব্যক্তির নৈতিক অধিকার হবে অহিংস সত্যাগ্রহের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় আইনকানুনকে প্রতিরোধ করা।
ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং শ্রেণিহীন সাম্যভিত্তিক সমাজব্যবস্থা
গান্ধিজি ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং শ্রেণিহীন সাম্যভিত্তিক সমাজব্যবস্থার পরিকল্পনা করেছিলেন। অর্থনৈতিক সাম্য বলতে গান্ধিজি চূড়ান্ত সাম্যের কথা বলেন নি। শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে শ্রেণিদ্বন্দ্ব বা শ্রেণি সংগ্রামের পথ পরিহার করে শ্রেণি-সমঝোতা বা শ্রেণি সহযোগিতার আদর্শকেই অনুসরণ করবার কথা বলেছেন। গান্ধিজির শোষণহীন সমাজ অহিংস নীতির ওপর ভিত্তিশীল।
চরম সার্বভৌমত্বের তত্ত্ব
রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে গান্ধিজির নিজস্ব ধারণার ফলে রাষ্ট্রের চরম সার্বভৌমত্বের তত্ত্বে তিনি আস্থাশীল ছিলেন না। কর্তৃত্বের ভিত্তিতে জনগণের সার্বভৌমত্বে তিনি বিশ্বাস করতেন। অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মতো, রাষ্ট্রও জনগণের কাছে সীমাবদ্ধ আনুগত্য দাবি করতে পারে। এতে নৈরাজ্যের আশঙ্কা থাকলেও রাষ্ট্রীয় শক্তির অপপ্রয়োগ রোধে গান্ধিজি এটি সমর্থন করেন।
সুতরাং, গান্ধিজির আদর্শ সমাজব্যবস্থা হল অহিংস নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রহীন গণতন্ত্র। এই গণতান্ত্রিক সমাজে প্রত্যেকেই শাসক। প্রত্যেকে এমনভাবে নিজেকে পরিচালিত করে যাতে অন্যের পক্ষে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি না হয়। এরূপ আদর্শ ব্যবস্থায় ক্ষমতার দ্বন্দ্বের প্রশ্ন থাকবে না। সত্য ও অহিংসার ভিত্তিতে গঠিত সত্যাগ্রহী গ্রামসমূহের সমবায় হল গান্ধিজির রাষ্ট্রহীন গণতন্ত্রের বাস্তব রূপ। এই সংগঠনের ভিত্তি হবে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছামূলক। সমাজজীবনে সাম্য বিরাজ করবে এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হবে। প্রত্যেক ব্যক্তি তার সামর্থ্য অনুযারী সমাজের জন্য কাজ করবে, প্রত্যেকে রুটির জন্য শ্রম করবে – এটিই হল রাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রের আদর্শ। এরূপ সমাজে শোষণের কোনো সুযোগ থাকবে না। রাষ্ট্রবিহীন অহিংস গণতন্ত্রই হল গান্ধিজির স্বপ্নের ‘রামরাজ্য’।
আদর্শ রাষ্ট্র সম্পর্কে চিন্তার ভিত্তিতে গান্ধিজি রাষ্ট্রের ওপর ন্যূনতম কাজের দায়িত্ব অর্পণের কথা বলেছেন। ডেভিড থরোর অনুকরণে তিনি বলেছেন, “আমি সেই সরকারকেই শ্রেষ্ঠ বলে মনে করি যা কম শাসন করে”। রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য হল সমাজকল্যাণ; সুতরাং, রাষ্ট্র তার কাজ পরিচালনায় এই মূল লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে সর্বাপেক্ষা কম শক্তি বা বলপ্রয়োগ করবে। জনসাধারণই হল মূল, রাষ্ট্র হল ফল। মূলে মিষ্টতা থাকলে ফল মিষ্ট হতে বাধ্য। সুতরাং, অহিংস রাষ্ট্রের কার্যাবলি হবে ন্যূনতম। অবশ্য বিশৃঙ্খলা বা নৈরাজ্য সৃষ্টির সমাজবিরোধী প্রবণতা রোধ করবার অধিকার রাষ্ট্রের থাকবে।
গান্ধিজির রাষ্ট্র সম্পর্কিত চিন্তা সম্পর্কে সমালোচনা
গান্ধিজির রাষ্ট্র সম্পর্কিত চিন্তা সমালোচকদের দ্বারা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সমালোচিত হয়েছে। যেমন –
- প্রথমত, সমালোচকদের মতে গান্ধিজির রাষ্ট্র চিন্তা মূলতঃ ধর্মীয় ও নৈতিকতার চেতনার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। স্বভাবতই এরূপ চিন্তাধারা বাস্তবতাকে অবহেলা করেছে।
- দ্বিতীয়ত, গান্ধিজির রাষ্ট্রচিন্তার মধ্যে স্ববিরোধীতা দেখা যায়। একদিকে তিনি রাষ্ট্রবিহীন গণতন্ত্রের কথা বললেও অন্যদিকে রাষ্ট্রের হাতে যতটা স্বল্প ক্ষমতা দেওয়া যায় তার সমর্থনে মতামত প্রকাশ করেন।
- তৃতীয়ত, রাষ্ট্র সম্পর্কিত গান্ধিজির ধারণা অবাস্তব বলে সমালোচকরা উল্লেখ করেন। তাঁদের মতে, রাষ্ট্র সম্পর্কিত গান্ধিজির ধারণা প্রতিনিধিত্বমূলক বা সর্বজনীন নয়। রাষ্ট্র সকল সময় হিংসা বা পীড়া দিয়ে তার সিদ্ধান্ত প্রয়োগ করে না। গণতান্ত্রিক চেতনার প্রসার, গণসচেতনতা, জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের ধারণা, স্বার্থবাহীগোষ্ঠীগুলির প্রভাব, রাজনৈতিক দলগুলির সক্রিয়তা রাষ্ট্রের হিংসাত্মক রূপের ব্যাপকতা কমিয়েছে একথা অনস্বীকার্য।
- চতুর্থত, গান্ধিজির ‘রামরাজ্যের’ ধারণা কাল্পনিক বলেও অনেক সমালোচক উল্লেখ করেন। সমালোচকদের মতে, কেবল সত্য ও অহিংসার উপর ভিত্তি করে আদর্শ সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা কল্পনাবিলাস।
- পঞ্চমত, মার্কসবাদীদের মতে, গান্ধিজি রাষ্ট্রের শ্রেণীচরিত্র উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। গান্ধিজি রাষ্ট্রকে হিংসা বা বলপ্রয়োগের হাতিয়ার বললেও শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গীতে তার ব্যাখ্যা করেন নি। মার্কসবাদীরা আরো বলেন, গান্ধিজি শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্বকে অস্বীকার করেছেন অথচ আবেদন নিবেদনের মাধ্যমে পৃথিবীর ইতিহাসে কখনো কোনো শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন হয় নি।
উপরিউক্ত সমালোচনা সত্ত্বেও বলা যায়, রাষ্ট্র সম্পর্কিত চিন্তার জগতে গান্ধীজীর চিন্তাধারা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার গুরুত্ব তাঁর রাষ্ট্রচিন্তার প্রয়োজনীয়তা উজ্জ্বল করে। ভারতের আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে গান্ধীজীর দর্শনের বিভিন্ন দিক প্রয়োগের প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়, এখানেই গান্ধীজীর প্রাসঙ্গিকতা।