আধুনিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে সার্বভৌমিকতার ধারণা – উত্তরের স্বপক্ষে যুক্তি

তুমি কি মনে কর আধুনিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে সার্বভৌমিকতার ধারণাটি অচল? তোমার উত্তরের স্বপক্ষে যুক্তি দাও। অথবা, তুমি কি মনে কর রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের ধারণাটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রযোগ করা সম্ভব? তোমার উত্তরের স্বপক্ষে যুক্তি দাও। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ।

আধুনিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে সার্বভৌমিকতার ধারণাটি অচল? / রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের ধারণাটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রযোগ করা সম্ভব? উত্তরের স্বপক্ষে যুক্তি

  • তুমি কি মনে কর আধুনিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে সার্বভৌমিকতার ধারণাটি অচল? তোমার উত্তরের স্বপক্ষে যুক্তি দাও। 
  • অথবা, তুমি কি মনে কর রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের ধারণাটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রযোগ করা সম্ভব? তোমার উত্তরের স্বপক্ষে যুক্তি দাও। 

সাধারণভাবে সার্বভৌমিকতা বলতে এককথায় রাজনৈতিক লোকসমাজে একটি চরম শেষ ক্ষমতাকে বোঝায়। সার্বভৌমিকতার প্রায়োগিক দিকে আলোকপাত করলে দেখা যায় এটি আইনগত দিক থেকে যেমন প্রতিষ্ঠিত তেমনি রাজনৈতিক দিকটিও গুরুত্বপূর্ণ। সার্বভৌমিকতার বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করলে দেখা যায় যে এটি মৌলিক ও চরম। এটির সার্বজনীনতা রয়েছে এবং এটি অবিভাজ্য। এমনকি এটি অ-হস্তান্তরযোগ্য। তাই কোন রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতা সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রকে আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উভয় দিক থেকে নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করে। 

রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ডের মধ্যে রাষ্ট্রের নির্দেশ বা আইন চরম ও চূড়ান্ত, যা আভ্যন্তরীণ সার্বভৌমিকতা নামে অভিহিত। আবার বাহ্যিক সার্বভৌমিকতা বলতে রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীন, স্বাধীনভাবে ও স্বেছায় পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ ও পরিচালনা করতে অন্য কোনো রাষ্ট্রের বা প্রতিষ্ঠানের দ্বারা পরিচালিত হবে না।

বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বিশ্ব রাজনীতির আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় সমাজবাদী শিবির ও ধনবাদী শিবিরের পারস্পরিক ঠান্ডা লড়াই, দ্বিমেরুকরণ, ক্ষমতার ভারসাম্যের লড়াই, সাম্রাজ্যবাদের নয়া রূপের প্রবর্তন এক পরিবর্তনের প্রবাহ বহন করে। পাশাপাশি নির্জোট আন্দোলনের প্রভাব বিশ্ব রাজনীতিতে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিংশ শতকের শেষ দশকে বিশেষ করে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ভাষানের ফলে সমগ্র বিশ্বে এক নতুন মেরুকরণ প্রতিষ্ঠিত হয়। পাশাপাশি নয়া সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার দেশসমূহের জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রগঠন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় এক নূতন দিগন্তের সূচনা করে। 

সর্বোপরি বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে সার্বভৌমিকতার তত্ত্বটি বিশেষ আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। ‘বিশ্বায়ন’ প্রক্রিয়ার ধারণা মূলত অর্থ ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠলেও বর্তমানে তা রাজনীতি ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছে। বর্তমান বিশ্বে বিশ্ব অর্থব্যবস্থা থেকে কোনো দেশ নিজেদের মুক্ত রাখতে সক্ষম হচ্ছে না। যা জাতি রাষ্ট্রগুলির সার্বভৌম ক্ষমতাকে সংকুচিত করছে।

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলি পারস্পরিক সম্পর্কিত হয়ে পড়ছে। কারণ, অর্থনীতির বিভিন্ন প্রক্রিয়াগুলির আন্তর্জাতিকীকরণ, বাজার দখলের লড়াই, সস্তায় কাঁচামাল ও শ্রমিক সংগ্রহ প্রভৃতির ফলে অর্থনীতিতে নিয়ন্ত্রণকারী শক্তিগুলির পরিবর্তন ঘটেছে। বহুজাতিক সংস্থাগুলি তাদের ব্যবসা বিভিন্নদেশের মধ্যে বিস্তৃত করে সে দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে কোনঠাসা করে দেয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতির ফলে সমাজের কোনো অংশ এর প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারে নি। বিভিন্ন দেশের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরতা বৃদ্ধি হয়েছে।

রাষ্ট্রগুলির পারস্পরিক চুক্তিতে আঞ্চলিক সংগঠন তৈরি হয়েছে। আঞ্চলিক সংগঠনগুলির সামরিক সংগঠন ন্যাটোর চুক্তিপত্রে যে যৌথ নিরাপত্তার কথা বলা আছে তা জাতি রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও সার্বভৌমিকতার পরিপন্থী। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা সার্ক, নির্জোট আন্দোলন প্রভৃতি আঞ্চলিক সংগঠনগুলির সদস্য গ্রহণের মাধ্যমে রাষ্ট্রগুলি কতকগুলি ঘোষিত লক্ষ্য ও অভিন্ন উদ্দেশ্য সাধনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। এককভাবে চলার স্বাধীনতা সংকুচিত করে তবে যৌথভাবে চলা যায়।

আন্তর্জাতিক সংগঠন সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ সহ আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল নামক আর্থিক সংস্থা প্রভৃতি কমবেশি সকল রাষ্ট্রের কাজকর্মে প্রভাব স্থাপন করে চলেছে। কোনো দেশকে অর্থ সাহায্য করার পূর্বে সংশ্লিষ্ট তহবিল ব্যয়ের জন্য আরোপিত শর্ত আবশ্যিক পালনীয়, যা সাহায্য গ্রহণকারী রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতার পক্ষে ক্ষতিকারক। আন্তর্জাতিক আইনগুলি রাষ্ট্রীয় আইনের ন্যায় কোনো সার্বভৌম কর্তৃত্ব সৃষ্ট না হলেও, রাষ্ট্রগুলির পক্ষে তা মান্য করা বাধ্যতামূলক না হলেও প্রতিটি রাষ্ট্রকেই তা কমবেশি মান্য করতে হয়।

সবশেষে বলা যায় সার্বভৌম ক্ষমতা সম্পন্ন জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণার উদ্ভবের পরিস্থিতি এবং বর্তমান আধুনিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার অবস্থান অনেকটা ভিন্ন। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে সার্বভৌমিকতার নিরঙ্কুশ আধিপত্যের অবস্থানে পরিবর্তন দেখা গিয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি কখনো আর্থিক সাহায্য, কখনো সন্ত্রাসবাদ দমন, কখনো শান্তি প্রতিষ্ঠা, কখনো বা সামরিক সাহায্য বা সাংস্কৃতিক সাহায্য প্রভৃতির নাম করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির সার্বভৌম ক্ষমতাকে সংকুচিত করছে। তাই সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চরম ও চূড়ান্ত সার্বভৌম ক্ষমতা সম্পন্ন জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণা অচল।

Leave a Comment