সার্বভৌমিকতার বহুত্ববাদী তত্ত্ব ব্যাখ্যা – এর সীমাদ্ধতাগুলি কি কি?

সার্বভৌমিকতার বহুত্ববাদী তত্ত্ব ব্যাখ্যা কর। এর সীমাদ্ধতাগুলি কি কি? অথবা, বহুত্ববাদের বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা কর।-রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব 

সার্বভৌমিকতার বহুত্ববাদী তত্ত্ব ব্যাখ্যা কর। এর সীমাদ্ধতাগুলি কি কি? অথবা, বহুত্ববাদের বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা

তত্ত্বগতভাবে সার্বভৌমিকতার ধারণা গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের চিন্তাধারা ও রোমান আইনের ধারণায় পাওয়া যায়। মধ্যযুগে বিশেষত দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতকে চার্চ ও রাষ্ট্রের ক্ষমতার বিরোধ সার্বভৌমিকতা সম্পর্কিত ধারণার সম্প্রসারণে সহায়তা করে। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে ক্ষমতা অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে রাজশক্তি ও জনশক্তির পারস্পরিক বিরোধ, ঐশ্বরিক অধিকার, রাজকীয় অধিকারের পরিবর্তে জনগণের অধিকারের ধারণার প্রকাশ সার্বভৌমিকতা সম্পর্কে ধারণার বিকাশ ঘটায়। ঊনবিংশ শতকে অস্টিনের বক্তব্যে সার্বভৌমিকতা বিশেষভাবে বিকশিত হয় এবং পরবর্তী সময়ে বিংশ শতকে বহুত্ববাদী হ্যারল্ড ল্যাস্কি অস্টিনের একাত্ববাদের বিরোধিতা করে সার্বভৌমিকতার আলোচনায় বহুত্ববাদের জন্ম দেন।

বহুত্ববাদ বলতে একাত্ববাদ প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রীভূত সর্বাত্মক ও অবাধ রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠিত মতবাদ। বহুত্ববাদ বলতে রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা একটিমাত্র কেন্দ্রে আবদ্ধ নয়, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। মেইটল্যান্ড, বার্কার, ল্যাস্কি, ম্যাকাইভার, কোল প্রমুখরা বহুত্ববাদের প্রধান বক্তা। বহুত্ববাদ মনে করে রাষ্ট্রের ন্যায় সমাজের বিভিন্ন সংঘ বা গোষ্ঠী সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা চরম, অবিভাজ্য ও অবাধ বলে একাত্ববাদীরা যে দাবি করেন তার বিরুদ্ধে বৌদ্ধিক আন্দোলনস্বরূপ বহুত্ববাদের জন্ম।

সার্বভৌমিকতার বহুত্ববাদের মূল বৈশিষ্ট্য :-

উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বহুত্ববাদের বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করা যায়। যেমন –

  • প্রথমত, এই মতবাদ অনুযারী সমাজে বহু গোষ্ঠী, সংগঠন ও সংস্থা ব্যক্তি মানুষের ও সমাজের প্রয়োজনে অপরিহার্য। তাই রাষ্ট্র কোনো অদ্বিতীয় সংস্থা নয়। 
  • দ্বিতীয়ত, মানুষের নিকট রাষ্ট্রের প্রয়োজনের ন্যায় শ্রমিক সংগঠন, বাণিজ্য সংগঠন প্রভৃতিরও প্রয়োজন দেখা যায়। মানুষের প্রয়োজনে স্বতস্ফুর্তভাবে একাধিক সংগঠন গড়ে ওঠে। সকলেই সংবিধানের নির্দেশ মান্য করে তাই পারস্পরিক বিরোধের সম্ভাবনা অধিক। তাই অনেকে বহুত্ববাদী চিন্তাধারার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে গণতান্ত্রিক ভারসাম্যের কথা উল্লেখ করেন।
  • তৃতীয়ত, বহুত্ববাদীদের মতে সমাজের অন্যান্য সংগঠনগুলি রাষ্ট্র সৃষ্টি করে না, স্বতস্ফূর্ত ভাবেই গড়ে ওঠে। 
  • চতুর্থত, বহুত্ববাদ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে সীমিত করে সংগঠন ও সমিতিগুলিকে স্বাতন্ত্র্য প্রদানের কথা বলে। এই অর্থে বলা যায় বহুত্ববাদ বিকেন্দ্রীকৃত ব্যবস্থায় বিশ্বাসী।
  • পঞ্চমত, এই মতবাদ অনুযায়ী রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা কোনোভাবেই অবিভাজ্য, অসীম বা চূড়ান্ত নয়।
  • ষষ্ঠত, বহুত্ববাদের মতে কোনো দেশেই সার্বভৌমের নির্দেশ আইনের স্বীকৃতি পায় না। এক্ষেত্রে আইনসভা আইন প্রণয়নের জটিল প্রক্রিয়াটি কার্যকরী করে। 
  • সপ্তমত, এই মতবাদ অনুযায়ী মানুষের প্রথম আনুগত্য যুক্তিবাদিতা ও বিবেকের উপর বর্তায়।

সার্বভৌমিকতার বহুত্ববাদের সীমাবদ্ধতা :-

বহুত্ববাদী তত্ত্বের বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকা সত্ত্বেও এর সীমাবদ্ধতাগুলি সমালোচকদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় নি। যেমন –

  • প্রথমত, সমালোচকদের মতে বহুত্ববাদীরা যেভাবে সমাজকাঠামো গড়ে তোলার ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাতে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য দেখা দিতে পারে। এমত অবস্থায় রাষ্ট্রের হাতে বিশেষ ক্ষমতা না থাকলে ওই বিরোধের মীমাংসা করতে পারে না। আবার দেশের সামগ্রিক নিরাপত্তা ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বিশেষ দায়িত্ব থাকে যা বিশেষ ক্ষমতা বলে সে করে থাকে – এটাই সার্বভৌমিকতা।
  • দ্বিতীয়ত, সমালোচকদের মতে মধ্যযুগে রাষ্ট্র, গীর্জা, সামন্তপ্রভু ও অন্যান্য গোষ্ঠীগুলির মধ্যে সার্বভৌম বিভাজিত ছিল, যা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিল। সমরূপভাবে বহুত্ববাদীরা সার্বভৌমিকতাকে বিভাজনের মধ্য দিয়ে সমাজের ঐক্য ও সংস্থাটিকে বিনষ্ট করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পথ উন্মোচিত করেছে।
  • তৃতীয়ত, সার্বভৌমিকতার ধারণাটি আইনগত ধারণা হওয়া সত্ত্বেও বহুত্ববাদীরা এটিকে নৈতিক ধারণা থেকে কোনো ভাবে পৃথক করেন নি। আইনগত ধারণা ও নৈতিক ধারণার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বিভিন্ন সংস্থাকে ক্ষমতা প্রদানের দাবি করেছেন।
  • চতুর্থত, সমালোচকদের মতে বহুত্ববাদ রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য করতে ব্যর্থ হয়েছে। সরকার ও রাষ্ট্র উভয়ের প্রধান পার্থক্য প্রথমটি মূর্ত ধারণা দ্বিতীয়টি বিমূর্ত ধারণা। তাছাড়া বিভিন্ন সরকারের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য থাকলেও বিভিন্ন রাষ্ট্রের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য অভিন্ন। তাই সরকার ও রাষ্ট্র অভিন্ন নয়।
  • পঞ্চমত, বহুত্ববাদের অন্যতম সমালোচক কোকার উল্লেখ করেছেন রাষ্ট্রের প্রয়োজন আইন প্রণয়ন ও তার প্রয়োগের জন্য। আইন প্রণয়নকারী ও প্রয়োগকারী হিসেবে দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের উপরে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কোকার আরো বলেন বহুত্ববাদের তত্ত্ব অস্পষ্ট দোষে দুষ্ট কারণ রাষ্ট্রের ক্ষমতা হ্রাসের কথা বহুত্ববাদীরা বললেও কোন কোন ক্ষমতা কম থাকবে তা তাঁরা স্পষ্ট করে উল্লেখ করেননি। 
  • ষষ্ঠত, বহুত্ববাদী ল্যাস্কিও পরবর্তী সময়ে এই মতবাদের সমালোচনা করে বলেন বহুত্ববাদ রাষ্ট্রের প্রকৃতিকে শ্রেণীগত দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করতে সমর্থ হয় নি। 
  • সপ্তমত, আইনের উৎস সম্পর্কিত বহুত্ববাদী ব্যাখ্যা গ্রহণ যোগ্য নয় বলে সমালোচকরা উল্লেখ করেন। বহুত্ববাদীরা আইনের উৎস হিসেবে ‘বিবেকের অনুশাসন’ ও ‘সামাজিক শৃঙ্খল’-এর কথা বলেন। কিন্তু সমালোচকরা বলেন আইন সভা বা নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ ব্যতীত আইন প্রণয়ন করার অধিকারী অন্য কেউ হতে পারে না।

বহুত্ববাদের বিরুদ্ধে একাধিক সমালোচনা সত্ত্বেও বহুত্ববাদের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বহুত্ববাদ স্বীকৃতি দেয় যে আইন প্রণয়ন সার্বভৌমের নির্দেশ নয় এটি একটি প্রক্রিয়া বিশেষ। বহুত্ববাদ বিভিন্ন সংস্থাসমূহের স্বাতন্ত্র্যকে স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণকে জোরাল সমর্থন করেছে। বহুত্ববাদ রাষ্ট্রের গুরুত্বকে অস্বীকার না করে তার চরম, সর্বাত্মক ও অবাধ কর্তৃত্বকে খর্ব করেছে। বহুত্ববাদের গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সংকট ও বিশ্ব আর্থিক মন্দার প্রভাব রাষ্ট্রীয় শক্তির বৃদ্ধির পরিবেশ তৈরি করে। অন্যদিকে জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের ভূমিকাকে সম্প্রসারিত করেছে।

Leave a Comment