সার্বভৌমিকতা সম্পর্কে অস্টিনের তত্ত্বটির উপর একটি সমালোচনা মূলক টীকা লেখ।
সার্বভৌমিকতা সম্পর্কে অস্টিনের তত্ত্বটির উপর একটি সমালোচনা মূলক টীকা লেখ
‘Lectures on Jurisprudence’ গ্রন্থে ব্রিটিশ আইনবিদ জন অস্টিন সার্বভৌমিকতার আইনগত দিকটি ব্যাখ্যা করেন। অস্টিন সার্বভৌমিকতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, “যদি কোনো সমাজে কোনো উচ্চতর ব্যক্তি বা ব্যক্তিসংসদ অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের আনুগত্য স্বীকার না করেও সমাজের অধিকাংশের স্বভাবজাত আনুগত্য লাভ করে তবে সংশ্লিষ্ট উচ্চতর ব্যক্তি বা ব্যক্তিসংসদ সার্বভৌম আর ওই সমাজ, রাজনৈতিক ও স্বাধীন সমাজ”।
অস্টিন আইনকে সার্বভৌমের নির্দেশ বলে আখ্যা দেন। তিনি আরও বলেন আইনের পেছনে সার্বভৌমের শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা থাকে। তাই এটি নৈতিকতার বা প্রথার সাথে কোনরূপ সম্পর্কিত নয়। অস্টিনের মতে সার্বভৌমের ইচ্ছাকে কেউ দমন করতে পারে না বা অন্য কোনো সংস্থার হাতে তুলে দিতে পারে না।
অস্টিনের তত্ত্বের উৎস :-
মূলত আইনের বিশ্লেষণমূলক ব্যাখ্যার অন্যতম প্রতিনিধি হিসেবে পরিচিত অস্টিন কান্ট বা হেগেলের অধিবিদ্যামূলক দার্শনিক চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হন নি। বরং অস্টিনের তত্ত্বে হবস ও বেন্থামের দর্শনের যথেষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
অস্টিনের ব্যাখ্যার বৈশিষ্ট্য :-
অস্টিন প্রদত্ত সার্বভৌমিকতার ব্যাখ্যা থেকে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করা যায় –
- প্রথমত, অস্টিনের ব্যাখ্যায় সার্বভৌম শক্তি একটি নির্দিষ্ট মানবীয় কর্তৃপক্ষ।
- দ্বিতীয়ত, কেবলমাত্র স্বাধীন রাজনৈতিক সমাজে এই সার্বভৌমিকতা অবস্থান করে।
- তৃতীয়ত, অস্টিনের নিকট প্রকৃতিগত দিক থেকে সার্বভৌম কর্তৃত্ব স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট।
- চতুর্থত, অস্টিনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সার্বভৌমের নির্দেশই আইন। এই নির্দেশ অমান্য করার অর্থে আইন অমান্য করা।
- পঞ্চমত, এই সার্বভৌমিকতা অবিভাজ্য। রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে অন্য কোনো সংস্থা বা ব্যক্তি এই ক্ষমতার অধিকারী নয়।
- ষষ্ঠত, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সকল ক্ষেত্রে সার্বভৌমের ক্ষমতা সমানভাবে প্রযোজ্য।
- সপ্তমত, অস্টিনের মতামত অনুযায়ী সার্বভৌমিকতার ভিত্তি হল জনগণের নিঃশর্ত ও স্বাভাবিক আনুগত্য।
অস্টিনের সার্বভৌমিকতার তত্ত্বের তাৎপর্য :-
অস্টিনের সার্বভৌমিকতার তত্ত্বটির কয়েকটি বিশেষ তাৎপর্যের কথা উল্লেখ করেছেন অধ্যাপক ল্যাস্কি। তাঁর মতে, (i) রাষ্ট্র আইনানুযারী গঠিত একটি সংস্থা। এখানে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব যাবতীয় ক্ষমতার উৎস। (ii) এই রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব চরম ও চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী হওয়ায় কোনো ক্ষমতার দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়। (iii) আইন হল সার্বভৌমের আদেশ। তাই আইন অমান্য করলে রাষ্ট্র শাস্তি দিতে পারে।
অস্টিনের তত্ত্ব -এর সমালোচনা :-
জন অস্টিনের সার্বভৌমিকতা তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা বিভিন্ন দিক থেকে আলোচিত হয়। যেমন –
- প্রথমত, অস্টিনের সার্বভৌমিকতার তত্ত্ব বাস্তবের সঙ্গে সঙ্গতিহীন। কারণ এই তত্ত্বে সার্বভৌমিকতা সম্পূর্ণভাবে আইনগত। ফলে রাজনৈতিক সার্বভৌমিকতা সম্পূর্ণ অবহেলিত হয়েছে।
- দ্বিতীয়ত, হেনরী মেইনের মতে অস্টিনের তত্ত্ব অযৌক্তিক ও কৃত্রিম। কারণ ইতিহাসে কোনো সময়ে সার্বভৌম অনির্দিষ্ট ক্ষমতা ভোগ করতে সক্ষম হয় নি। যখনই এরূপ প্রবণতা দেখা দিয়েছে তখনই সেই শক্তিকে প্রতিহত করার চেষ্টা হয়েছে।
- তৃতীয়ত, বহুত্ববাদীদের মতে রাষ্ট্র ব্যতীত সমাজের মধ্যে সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় বিভিন্ন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি মানুষের উন্নয়নে বিভিন্নভাবে সহায়তা করে। স্বাভাবিক কারণেই ওই সকল প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি মানুষের আনুগত্য লাভ করে। ল্যাস্কির মতে মানুষের আনুগত্য যেহেতু বহুমুখী স্বভাবতই রাষ্ট্র একক চরম সার্বভৌমিকতা দাবি করতে পারে না।
- চতুর্থত, আন্তর্জাতিকতাবাদীরা অস্টিনের তত্ত্বের সমালোচনা করে বলেন যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোনো রাষ্ট্র চরম অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা ভোগ করতে অক্ষম।
- পঞ্চমত, অনেকে অস্টিনের সার্বভৌমিকতার ব্যাখ্যাকে অগণতান্ত্রিক বলে ব্যাখ্যা করেন। তাদের মতে অস্টিনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী আইনগত সার্বভৌমিকতা চরম ও অনিয়ন্ত্রিত। তাই সার্বভৌম যে কোনো সময় দমনমূলক ও পীড়নমূলক হয়ে উঠতে পারে, যা গণতান্ত্রিক আদর্শ বহির্ভূত।
- ষষ্ঠত, মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে অস্টিনের সার্বভৌকিতার তত্ত্ব প্রতিক্রিয়াশীল তত্ত্ব। কারণ বর্ণবৈষম্যমূলক সমাজে সার্বভৌম কর্তৃত্ব মুষ্টিমেয় সম্পত্তিবানের স্বার্থরক্ষায় রাষ্ট্রীয় যন্ত্রকে ব্যবহার করে।
অস্টিনের সার্বভৌমিকতার ব্যাখ্যা নানান ভাবে সমালোচিত হলেও এর গুরুত্ব অনস্বীকার্য। গার্নার মন্তব্য করেছেন, “সার্বভৌমিকতার আইনগত চরিত্র বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অস্টিনের তত্ত্ব সুস্পষ্ট ও যুক্তিপূর্ণ”। ফ্রান্সিস গ্রাহাম উইলসনের মতে অস্টিন সার্বভৌমিকতার সংজ্ঞায় জনগণের স্বভাবজাত আনুগত্যের কথা বলেছেন, যা সার্বভৌমত্বকে জনগণের সম্মতির উপর প্রতিষ্ঠা করে।