রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনায় মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা কর।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনায় মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা
রাজনীতি চর্চার শুরু থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাক্ষেত্র ও রাজনীতির বিশ্লেষণকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যায়। দৃষ্টিভঙ্গি বলতে বোঝায় আলোচিত বিষয়সমূহ ও তার সাথে সম্পর্কিত তথ্যসমূহ নির্ধারণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত মানদণ্ড। এদিক থেকে বলা যায় দৃষ্টিভঙ্গি বলতে বোঝায় ‘মানদণ্ড নির্ধারণ’। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সামাজিক অগ্রগতি ও ডারউইনের বিবর্তনবাদ, মার্কসের ঐতিসাহিক মতবাদ, ভৌতবিজ্ঞান ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের নতুন নতুন গবেষণা, অনুসন্ধান প্রভৃতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করেছে এবং তার সাথে রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটিয়েছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা ক্ষেত্রকে কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার বিশ্লেষণ করা হবে তা নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে ভিন্ন মত পরিলক্ষিত হয়। রাজনৈতিক আলোচনার দৃষ্টিভঙ্গিকে তথ্য ও মূল্যমান সংক্রান্ত সমস্যার ভিত্তিতে দুইভাগে ভাগ করা হয় –
- (ক) আদর্শ স্থাপনকারী দৃষ্টিভঙ্গি বা মূল্যমান সাপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি এবং
- (খ) অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি।
কোনো কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী চার ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির কথা উল্লেখ করেছেন –
- (ক) দার্শনিক,
- (খ) প্রতিষ্ঠানিক,
- (গ) আচরণবাদী এবং
- (ঘ) মার্কসবাদী।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনায় মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি :-
সাধারণভাবে উদারনীতিবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত দৃষ্টিতে এই বিশ্ব ও মানব সমাজ সম্পর্কে কাল মার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী ব্যাখ্যাই মার্কসবাদ নামে পরিচিত। যদিও বর্তমানে মানব সমাজ সম্পর্কে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী ব্যাখ্যার সমর্থকরা সকলেই মার্কসবাদের অন্তর্ভুক্ত। তথা মার্কসবাদ একটি বিশ্ব বিক্ষায় রূপ নিয়েছে। মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মূল কথা হল রাষ্ট্র, সরকার ও রাজনীতি হল সমাজের শ্রেণিবিভাজনের ফসল।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনায় মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গির বৈশিষ্ট্য :-
মার্কসীয় দৃষ্টিতে রাজনৈতিক পর্যালোচনার বৈশিষ্ট্যগুলি হল –
- প্রথমত, মার্কসবাদীরা রাজনীতিসহ সমাজের সকল অংশকে একত্রিত করে আলোচনা করেন।
- দ্বিতীয়ত, মার্কসীয় দৃষ্টিতে রাজনীতি সমাজের উপরি কাঠামোর অন্যতম অংশ, যা রাষ্ট্র ও তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত। লেনিন উল্লেখ করেন, “রাজনীতি হল শ্রেণিসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক। রাজনীতি হল রাষ্ট্রের ব্যাপারে অংশগ্রহণ, রাষ্ট্র পরিচালনা ও রাষ্ট্রের কার্যকলাপের রূপ, উদ্দেশ্য ও বিষয়বস্তু নির্ধারণ”। মার্কসবাদীরা অর্থনীতিকে সমগ্র সমাজব্যবস্থার ভিত হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। লেনিন বলেন, “রাজনীতি হল অর্থনীতির ঘনীভূত রূপ।
- তৃতীয়ত, মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রবক্তারা রাজনৈতিক পর্যালোচনায় দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করেছেন।
- চতুর্থত, মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রবক্তারা রাজনৈতিক আলোচনায় ভিত্তি ও উপরিকাঠামোর তত্ত্ব প্রয়োগ করেছেন। ভিত্তি বলতে বৈষয়িক জীবনের উৎপাদন পদ্ধতিকে বলা যায়। এর দুটি দিক – উৎপাদন সম্পর্ক (উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে জড়িত মানুষে মানুষে যে সম্পর্ক) এবং উৎপাদিকা শক্তি (শ্রমিক তার শ্রম, যন্ত্রপাতি বা কাঁচামাল)। উৎপাদিকা শক্তি দ্রুত পরিবর্তনশীল উৎপাদন সম্পর্কের যে ভিত্তি প্রস্তুত করে তার উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে উপরি কাঠামো অর্থাৎ রাজনীতি, ধর্ম, দর্শন, সভ্যতা – সংস্কৃতি প্রভৃতি।
- পঞ্চমত, এই দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থকরা উল্লেখ করেন যে সমাজ জীবনের সকল কিছুই অর্থনীতির সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। অর্থনীতি নিরপেক্ষ কোনো আলোচনা অবৈজ্ঞানিক। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয় রাষ্ট্র, সরকার, আইন ও প্রাসঙ্গিক বিষয়সমূহ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করে আলোচনা করলে তা অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
- ষষ্ঠত, মার্কসবাদীরা ক্ষমতার ধারণাকে রাজনৈতিক তত্ত্বের অন্যতম মৌল ধারণা বলে স্বীকৃতি দেন। সেই অর্থে মার্কসবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গিতে রাজনীতি হল শ্রেণীগত ধারণা, যা ক্ষমতাকে কার্যকর করার ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে যুক্ত থাকে।
- সপ্তমত, এই দৃষ্টিভঙ্গিতে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মাধ্যমে মানবসমাজের ক্রমবিকাশের ব্যাখ্যাকে বৈজ্ঞানিকভিত্তি প্রদান করার প্রয়াস হয়েছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনায় মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা :-
রাজনীতির পর্যালোচনায় মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি সমালোচকদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় নি। সমালোচকরা বলেন মার্কসবাদে মানব সমাজের সকল কিছু মূল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে গ্রহণের মাধ্যমে সমাজের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক প্রভৃতি অন্যান্য উপাদানের গুরুত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে রাজনৈতিক চর্চা স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে আলোচিত হয় নি।
সবশেষে বলা যায় সমালোচনা সত্ত্বেও একথা অনস্বীকার্য যে রাজনৈতিক পর্যালোচনায় মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি একটি আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি যা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে সমাজের বিকাশকে ব্যাখ্যা করে। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি কেবল প্রচলিত ব্যবস্থাকে নিয়ে আলোচনা করে না তার পরিবর্তনের কথাও বলে। এখানেই অন্যান্য দৃষ্টিভঙ্গির সাথে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গির তফাৎ।