রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আলোচনা কর।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আলোচনা কর
রাজনীতি চর্চার শুরু থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাক্ষেত্র ও রাজনীতির বিশ্লেষণকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যায়। দৃষ্টিভঙ্গি বলতে বোঝায় আলোচিত বিষয়সমূহ ও তার সাথে সম্পর্কিত তথ্যসমূহ নির্ধারণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত মানদণ্ড। এদিক থেকে বলা যায় দৃষ্টিভঙ্গি বলতে বোঝায় ‘মানদণ্ড নির্ধারণ’।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে সামাজিক অগ্রগতি ও ডারউইনের বিবর্তনবাদ, মার্কসের ঐতিসাহিক মতবাদ, ভৌতবিজ্ঞান ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের নতুন নতুন গবেষণা, অনুসন্ধান প্রভৃতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করেছে এবং তার সাথে রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটিয়েছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা ক্ষেত্রকে কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার বিশ্লেষণ করা হবে তা নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে ভিন্ন মত পরিলক্ষিত হয়।
রাজনৈতিক আলোচনার দৃষ্টিভঙ্গিকে তথ্য ও মূল্যমান সংক্রান্ত সমস্যার ভিত্তিতে দুইভাগে ভাগ করা হয় –
- (ক) আদর্শ স্থাপনকারী দৃষ্টিভঙ্গি বা মূল্যমান সাপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি এবং
- (খ) অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি।
কোনো কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী চার ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির কথা উল্লেখ করেছেন –
- (ক) দার্শনিক,
- (খ) প্রতিষ্ঠানিক,
- (গ) আচরণবাদী এবং
- (ঘ) মার্কসবাদী।
আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সংজ্ঞা :-
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রবার্ট ডাল কর্তৃক বর্ণিত, ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যে একটি প্রতিবাদ আন্দোলন’ এবং ডেভিড ইস্টন কর্তৃক চিহ্নিত ‘তাত্ত্বিক বিপ্লব’ নামে বিশ শতকে যে দৃষ্টিভঙ্গির উদ্ভব তাই আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। আচরণবাদের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে গিল্ড ও পামার উল্লেখ করছেন, “যে কোনো ঘটনার সুশৃঙ্খল, অভিজ্ঞতাবাদী ও কার্যকারণ সম্পর্কিত ব্যাখ্যাকে বলা হয় ‘আচরণবাদ’। ডেভিড ইস্টনের মতে “আচরণবাদ একটি বৌদ্ধিক ঝোঁক এবং একটি সুনির্দিষ্ট শিক্ষা বিষয়ক আন্দোলন।” আরনল্ড ব্রেস্ট এর মতে, “আচরণবাদ হল রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে এক অভিজ্ঞতাবাদী ও স্থায়ী তত্ত্ব গঠনের প্রয়াস”। এই দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থকরা হলেন আর্থার বেন্টলে, গ্রাহাম ওয়ালাস, ল্যাসওয়েল, মেরিয়াম, রবার্ট ডাল, ডেভিড ইস্টন প্রমুখ।
আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বৈশিষ্ট্য :-
আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য গুলি হল –
- প্রথমত, আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা মূলত মূল্যমান নিরপেক্ষ করার প্রয়াস হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর রাজনৈতিক আচরণ বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ব্যাখ্যা করা হয়।
- দ্বিতীয়ত, এই দৃষ্টিভঙ্গিতে তত্ত্ব ও গবেষণার পারস্পরিক নির্ভরশীলতার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপিত হয়।
- তৃতীয়ত, আচরণবাদী সমর্থকরা সমাজবিজ্ঞানগুলির পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে তোলার পক্ষপাতী।
- চতুর্থত, এই দৃষ্টিভঙ্গিতে রাজনৈতিক ঘটনার কার্যকারণ সম্পর্ক অন্বেষণ করা হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থকরা ঔচিত্য অনৌচিত্য নিয়ে আলোচনা করেন না। এদিক থেকে এই দৃষ্টিভঙ্গিকে মূল্যমান নিরপেক্ষ বলা যায়।
- পঞ্চমত, কঠোর বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি অবলম্বনে কোনো রাজনৈতিক ঘটনার পর্যালোচনা করেন আচরণবাদীরা। তাই এক্ষেত্রে তথ্য সংগ্রহ, শ্রেণীবিন্যাস, বিচার বিশ্লেষণ, পরীক্ষাযোগ্য সিদ্ধান্তগ্রহণ এবং তথ্যের পরিমাপ ও সংখ্যায়ণের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপিত হয়।
- ষষ্ঠত, আচরণবাদীরা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক আলোচনার বিরোধি। ক্ষমতা প্রয়োগের সাথে সম্পর্কিত যেকোনো বিষয় রাজনৈতিক পর্যালোচনার বিষয় বলে এঁরা মনে করেন।
আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা :-
রাষ্ট্রবিজ্ঞান পর্যালোচনায় সনানতী দৃষ্টিভঙ্গিকে সংকটাপন্ন করে বিংশশতাব্দীর বিশশতকে যে আচরণবাদের উদ্ভব হয় তা সমালোচনার উর্ধে নয়। যেমন –
- প্রথমত, আচরণবাদী আলোচনায় সংখ্যায়ন, রেখা চিত্র, তালিকা প্রণয়ন প্রভৃতি অভিজ্ঞতাবাদী তত্ত্বের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপিত হয় তাই সমালোচকরা এটিকে ‘সংখ্যাতত্ত্বের’ নামান্তর বলে উল্লেখ করেন।
- দ্বিতীয়ত, আন্তঃসমাজবিজ্ঞানকেন্দ্রিক আলোচনার ঝোঁক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের স্বতন্ত্র অস্তিত্ত্ব সংকটাপন্ন করে তুলেছে।
- তৃতীয়ত, সমালোচকদের মতে আচরণবাদী আলোচনা বুর্জোয়া সমাজকে স্থিতাবস্থায় রাখার তত্ত্বগত প্রয়াস। কারণ এই দৃষ্টিভঙ্গিতে সামাজিক শক্তিগুলিকে ব্যাখ্যা করার পরিবর্তে তথ্যাদি সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের দ্বারা বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সংরক্ষণ ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের উদোগ নেওয়া হয়।
- চতুর্থত, অনেকে এই তত্ত্বকে রক্ষণশীল বলে উল্লেখ করেন। সমালোচকদের মতে আচরণবাদের মূল উদ্দেশ্য স্থিতাবস্থা বজায় রাখা।
- পঞ্চমত, অনেকে এই মতবাদকে অবৈজ্ঞানিক বলে উল্লেখ করেন। সমালোচকদের মতে ভৌতবিজ্ঞানের নীতি অনুসরণ করে সমাজের পুরোপুরি বাস্তব চিত্র তুলে ধরা সম্ভব নয়।
ভিন্ন প্রকার সীমাবন্ধতা সত্ত্বেও বলা যায় আচরণবাদ রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ। ব্যক্তির ভোট আচরণ, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের চর্চা প্রভৃতি ক্ষেত্রে আচরণবাদী বিশ্লেষণের কার্যকারিতা অনস্বীকার্য। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে মানুষের ভূমিকাকে গুরুত্ব প্রদান করে এই আচরণবাদ।