রাষ্ট্রবিজ্ঞান কি বিজ্ঞান পদবাচ্য ? উত্তরের স্বপক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি

রাষ্ট্রবিজ্ঞান কি বিজ্ঞান পদবাচ্য ? তোমার উত্তরের স্বপক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি দাও।

রাষ্ট্রবিজ্ঞান কি বিজ্ঞান পদবাচ্য ? তোমার উত্তরের স্বপক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি দাও।

রাষ্ট্রবিজ্ঞান কি বিজ্ঞান পদবাচ্য ?

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক অ্যারিস্টটল রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান হিসেবে উল্লেখ করলেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান বলা যাবে কিনা তা নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে যথেষ্ট মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। মন্তেস্কু, হবস, লর্ড ব্রাইস, বোডিন, সিজউইক এবং আধুনিক আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান হিসেবে মেনে নেন। অন্যদিকে ক্লার্ক, মেটল্যান্ড, বাকল প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এই শাস্ত্রকে বিজ্ঞান বলে মানতে রাজী নন।

মেটল্যান্ডের মতে, যখন আমি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র দেখি যার শিরোনাম রাষ্ট্রবিজ্ঞান, তখন আমি প্রশ্নগুলির নয় বরং শিরোনামের জন্য দুঃখ বোধ করি। বাকল মনে করেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান বলা তো চলেই না এমন কি কলা বিভাগের বিষয়গুলির মধ্যে সবচেয়ে অনুন্নত। তিনি উল্লেখ করেছেন, “সৌন্দর্য তত্ত্বের বিজ্ঞান বলে যেমন কিছু নাই, তেমনি রাষ্ট্রতত্ত্বেরও কোন বিজ্ঞান নাই।”

প্রসঙ্গত রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিজ্ঞান পদবাচ্য কি না এ প্রসঙ্গে দুটি বিষয় আমাদের আলোচনা প্রয়োজন। প্রথমত, বিজ্ঞান কাকে বলে? দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণের প্রয়োগের কোনো ঐতিহাসিক নজীর আছে কিনা? প্রথমটির উত্তরে সাধারণ ভাবে বলা যায়, বিজ্ঞান বলতে বোঝায়, কোন বিষয়ে সুসংবদ্ধ জ্ঞান অর্জন। বিজ্ঞানীরা সুসংবদ্ধ জ্ঞান থেকে কতকগুলি সূত্র নির্ধারণ করেন এবং ক্ষেত্র বিশেষে সেগুলি প্রয়োগ করে বিষয়বস্তুর সত্যাসত্য নির্ধারণ করে। দ্বিতীয়টির উত্তরে বলা যায়, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক গ্রীক পন্ডিত অ্যারিস্টটল রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনার ক্ষেত্রে ধারাবাহিক পর্যবেক্ষণের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন। মেকিয়াভেলীর হাতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নীতিশাস্ত্র থেকে মুক্তি পায়।

এরূপ প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিজ্ঞান কি না আমরা দুটি ভাবে আলোচনা করতে পারি। (ক) স্বপক্ষে ও (খ) বিপক্ষে। 

রাষ্ট্রবিজ্ঞান কি বিজ্ঞান পদবাচ্য ? উত্তরের স্বপক্ষে যুক্তি

(ক) স্বপক্ষে :- যারা রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান বলে অভিহিত করতে চান তাঁদের মত হল –

  • প্রথমত, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত বিষয়সমূহের ক্ষেত্রেও অন্যান্য বিজ্ঞানের ন্যায় পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ ও গবেষণা প্রভৃতি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাহায্যে সুসংবদ্ধ জ্ঞান লাভ করা যায়। 
  • দ্বিতীয়ত, বিজ্ঞান বলতে যদি পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ, পরীক্ষা ও অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান, যা সুংসহত, সুশৃঙ্খলিত ও কার্যকারণ সূত্রে গ্রথিত তাই হয় তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিজ্ঞান। পোলকের মতে, যাঁরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান বলে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন তাঁরা বিজ্ঞান বলতে কী বোঝায় তা জানে না। এক্ষেত্রে বলা যায় বিজ্ঞানের মূল সূত্রগুলি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পাওয়া যায়।
  • তৃতীয়ত, প্রকৃতি বিজ্ঞানের জ্ঞান বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে আহরিত হলেও অনেক সময় তা ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়। তখন নতুন তত্ত্ব ও সূত্র আবিষ্কৃত হয়। অতএব রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তত্ত্ব ও সূত্র স্থানীয় নয় বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিজ্ঞান নয়, এই যুক্তি যথার্থ নয়। 
  • চতুর্থত, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে শৃঙ্খলিত জ্ঞান, সাধারণ সূত্র ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তা বৈজ্ঞানিক সত্যের প্রমাণ দাবী করে। 
  • পঞ্চমত, তথ্য ও তত্ত্ব উভয়েই রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সমান গুরুত্বপূর্ণ যা রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সহায়ক। 
  • ষষ্ঠত, একমাত্র প্রমাণের যোগ্যতাকে মাপকাঠি না করে যুক্তির শৃঙ্খলা দিয়ে কোনো বক্তব্যকে প্রকাশ ও প্রতিষ্ঠা করাও বিজ্ঞান। এদিক থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিজ্ঞান পদবাচ্য। 
  • সপ্তমত, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিকাশের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা পরিলক্ষিত হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে নীতিশাস্ত্র নিরপেক্ষ করেছিলেন মেকিয়াভেলি। আবার লক রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে অধিবিদ্যার হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন।
  • অষ্টমত, জর্জ ক্যাটালিন উল্লেখ করেছেন, বিশ্লেষিত ও শ্রেণিবিভক্ত জ্ঞান থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান সাধারণ সূত্রের প্রতিষ্ঠা করে বলে একে বিজ্ঞান বলা যায়। তথ্য, পরিসংখ্যান, আচার-আচরণকে ভিত্তি করে আচরণবাদীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বৈজ্ঞানিক পরিমণ্ডল গড়ার জন্য একটা ধারণা বা কাঠামো গড়ে তুলতে চান। আচরণবাদীরা দাবি করেন মূল্যবোধ ও আদর্শ নিরপেক্ষ ভাবে গড়ে ওঠা একটা শাস্ত্র কে বিজ্ঞান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া যায়।

রাষ্ট্রবিজ্ঞান কি বিজ্ঞান পদবাচ্য ? উত্তরের বিপক্ষে যুক্তি

(খ) বিপক্ষে :- যাঁরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান হিসেবে স্বীকার করতে রাজী নন তাঁদের মত হল –

  • প্রথমত, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা ক্ষেত্র ব্যাপক, জটিল ও পরিবর্তনশীল হওয়ায় কোনো নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবেষণা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে ভিন্ন পদ্ধতির প্রয়োগ দেখা যায়। যেমন – পর্যবেক্ষণমূলক পদ্ধতি, তুলনামূলক পদ্ধতি, ঐতিহাসিক পদ্ধতি, দার্শনিক পদ্ধতি প্রভৃতি যা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রয়োগ ঘটে না।
  • দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের ন্যায় কার্যকারণের মধ্যে বর্তমান থাকা নির্দিষ্ট সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয় না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সাধারণ সূত্রের অভাব পরিলক্ষিত হয়।
  • তৃতীয়ত, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সকল বিষয় বিশুদ্ধ গবেষণাগারে গবেষণা করা যায় না। 
  • চতুর্থত, এটি প্রকৃত বিজ্ঞান নয় কারণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা কখনই বাস্তব ক্ষেত্রে তাঁদের আবিষ্কৃত সূত্রগুলি পরীক্ষা করতে পারেন না।
  • পঞ্চমত, কনফোর্থের মতে, “মানুষের সামাজিক সম্পর্ককে কোনো অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে পরীক্ষা করা যায় না তাকে পৃথক করে কোনো রাসায়নিক বিকারের সাহায্যে তার প্রকৃতিও আবিষ্কার করা যায় না।” এক্ষেত্রে সমাজ বিজ্ঞানের শাখা হিসেবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানেও তা সম্ভব নয়। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিজ্ঞান নয়।
  • ষষ্ঠত, মূল্যবোধ ও আদর্শের প্রশ্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সঙ্গে জড়িত থাকায় বিষয়টির মূল্য নিরপেক্ষ হয়ে আলোচনা সম্ভবপর নয়।
  • সপ্তমত, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সংখ্যায়নের সঠিক প্রয়োগ সম্ভব নয় বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান পদবাচ্য বলা যায় না। 
  • অষ্টমত, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অভিব্যক্তির মধ্যে যে অন্তর্নিহিত সত্য থাকে তা জটিল হওয়ায় সহজে আবিষ্কার করা যায় না। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিজ্ঞান নয়।

রাষ্ট্রবিজ্ঞান কি বিজ্ঞান পদবাচ্য ? উত্তরের স্বপক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তির পর্যালোচনা

উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে গবেষণাগারে পরীক্ষা করার তেমন সুযোগ নাই। আবার এক্ষেত্রে সাধারণ সূত্রের অভাব পরিলক্ষিত হয় তাই মূলত পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয়। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে পর্যবেক্ষণমূলক বিজ্ঞান বলে অনেকে উল্লেখ করেন। আবার পর্যবেক্ষণ, অভিজ্ঞতা ও তুলনামূলক পদ্ধতির প্রয়োগে আহরিত জ্ঞান বিজ্ঞান হিসাবে বিবেচিত হলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিজ্ঞান তবে সে অর্থে পদার্থ বিজ্ঞান বা রসায়ন বিজ্ঞানের ন্যায় বিজ্ঞান নয়। লর্ড ব্রাইস রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে অপরিণত বিজ্ঞান বলে উল্লেখ করেছেন। এদিক থেকে ডাইসী রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে প্রগতিশীল বিজ্ঞান বলে উল্লেখ করছেন।

Leave a Comment