রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা ক্ষেত্র ও পরিধি

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা ক্ষেত্র ও পরিধি আলোচনা কর।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা ক্ষেত্র ও পরিধি আলোচনা কর

সমাজ বিজ্ঞানের অন্যতম শাখা রাষ্ট্রবিজ্ঞান। স্বভাবতই অন্যান্য শাখার ন্যায় ইহারও বিশেষ আলোচনাক্ষেত্র ও পরিধি রয়েছে। পরিবর্তনশীল মানবসমাজ নিয়ে সদা আলোচনাকারী রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা ক্ষেত্রও দ্রুত পরিবর্তনশীল। সি. সি. রোডীর মতে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কোনো সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট সীমারেখা টানা সম্ভব নয়।” রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞার ন্যায় আলোচনা ক্ষেত্র ও পরিধি নিয়েও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতের ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলোচনা ক্ষেত্র :-

রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সংজ্ঞা প্রদানকারীদের মতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মুখ্য আলোচ্য বিষয় রাষ্ট্র। গার্নারের মতে, “রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সূচনা ও সমাপ্তি রাষ্ট্রকে নিয়ে”। ব্লুন্টসলি উল্লেখ করেছেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্যসূচি হল রাষ্ট্র”। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের উৎপত্তি, প্রকৃতি, উদ্দেশ্য, রাষ্ট্রগুলির কার্যাবলী, জনগণের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক প্রভৃতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রধান আলোচ্য বিষয়।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সরকার কেন্দ্রিক আলোচনা ক্ষেত্র :-

সিলি, স্মিথ, পলজানে প্রমুখ যাঁরা সরকার কেন্দ্রীক সংজ্ঞা প্রদান করেন তাদের মতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রধান আলোচ্য বিষয় সরকার। সিলির মতে, “অর্থনীতি, জীববিদ্যা, বীজগণিত ও জ্যামিতি যেমন যথাক্রমে সম্পদ, জীবন, সংখ্যা এবং স্থান ও বিস্তার নিয়ে আলোচনা করে তেমনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানও সরকারের নানান দিক নিয়ে আলোচনা করে।” অধ্যাপক গেটেল বলেন, “রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল রাষ্ট্র কী ছিল সে সম্পর্কে ঐতিহাসিক অনুসন্ধান, বর্তমানে রাষ্ট্র কী সে সম্পর্কে বিশ্লেষণমূলক আলোচনা এবং ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র কেমন হওয়া উচিত সে সম্পর্কে রাষ্ট্রনৈতিক ও নীতি সম্মত আলোচনা।”

রাষ্ট্র ও সরকার উভয়কেন্দ্রিক আলোচনা ক্ষেত্র :-

অবশ্য গেটেল, গিলক্রিস্ট, পলজানে ল্যাস্কি প্রমুখরা রাষ্ট্র ও সরকার উভয়কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয় বলে উল্লেখ করেন। অধ্যাপক গিলক্রিস্টও উল্লেখ করছেন, “রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্র ও সরকার নিয়ে আলোচনা করে”। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী পলজানে উল্লেখ করছেন, “রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল সমাজ বিজ্ঞানের সেই শাখা যা রাষ্ট্রের ভিত্তি ও সরকারের নীতিসমূহের আলোচনা করে।”

রাষ্ট্র, সরকার ও আইন কেন্দ্রিক আলোচনা ক্ষেত্র :-

আবার উইলোবি প্রমুখরা সরকার কর্তৃক প্রণীত আইনকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয় বলে উল্লেখ করেন। উইলোবি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয় হিসেবে রাষ্ট্র, সরকার ও আইন – এই তিনটি বিষয়কে উল্লেখ করেছেন।

ব্যক্তি গোষ্ঠী বিরোধ মীমাংসা বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা ক্ষেত্র :-

আধুনিক ও আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের আলোচনায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা ব্যাপকতা লাভ করে। এক্ষেত্রে গ্রাহাম ওয়ালস, রবার্ট ডাল, আর্থার বেন্টলে, অ্যালান বল, ডেভিড ট্রুম্যান, মিলার, চার্লস মেরিয়াম, ডেভিড ইস্টন, ল্যাসওয়েল প্রমুখর নাম উল্লেখযোগ্য। বরাট ডাল ও লাসওয়েল প্রভাব ও প্রভাবশালীদের সম্পর্কে আলোচনাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার বিষয় বলে উল্লেখ করেছেন। অ্যালান বল ক্ষমতা ও ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং তার মীমাংসাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয় বলে উল্লেখ করছেন।

রাজনৈতিক তত্ত্ব ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা ক্ষেত্র :-

প্রসঙ্গত বলা যায়, প্লেটো ও এরিস্টটলের রাষ্ট্রনৈতিক তত্ত্ব থেকে শুরু করে রোমান দার্শনিক সিসেরোর আইন সংক্রান্ত আালোচনা, ম্যাকিয়াভেলীর ধর্ম বিযুক্ত রাজনীতি সংক্রান্ত আলোচনা, বোডিনের সার্বভৌমিকতার তত্ত্ব, হবস কর্তৃক মানুষের প্রকৃতি সংক্রান্ত আলোচনা, সামাজিক চুক্তি মতবাদ, লক কর্তৃক আলোচিত গণতন্ত্র ও নিয়ন্ত্রিত সরকারের আলোচনা, রুশোর সাধারণের ইচ্ছা সংক্রান্ত আলোচনা, মন্তেস্কুর ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ তত্ত্ব, বেন্থাম ও মিলের উপযোগবাদ, কান্ট, হেগেল, ব্রাডলে, গ্রীন প্রমুখর ভাববাদী দার্শনিক মতবাদ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা ক্ষেত্রের অন্তর্ভুক্ত অন্যতম বিষয়।

উপসংহার

সবশেষে বলা যায়, সমাজের পরিবর্তনের সাথে সাথে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা ক্ষেত্রেরও পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। বর্তমানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা ক্ষেত্র আরো ব্যাপকতা লাভ করেছে। সমাজ বিজ্ঞানের শাখা হিসেবে সমাজবিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা, যেমন – ইতিহাস, অর্থনীতি, সামাজিক মনস্তত্ব প্রভৃতির আংশিক আলোচনা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা ক্ষেত্রের অন্তর্ভুত। আবার সাম্প্রতিককালে পৌরসমাজের ভূমিকা আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের রাজনৈতিক আলোচনার অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বায়ন বিরোধী বিশ্ব সামাজিক মঞ্চ, পরিবেশ সংরক্ষণে বিভিন্ন পরিবেশ রক্ষা মঞ্চ, নারীবাদী আন্দোলন মঞ্চ প্রভৃতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা ক্ষেত্রের অন্তর্ভুত হয়ে পড়েছে।

Leave a Comment