রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা দাও। অথবা, রাষ্ট্র বিজ্ঞানের রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সংজ্ঞা আলোচনা কর।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা দাও। অথবা, রাষ্ট্র বিজ্ঞানের রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সংজ্ঞা আলোচনা কর।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা
মনুষ্য সমাজের বিরামহীন বিকাশের ইতিহাসের সাথে রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কিত ধ্যানধারনা ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। তাই সক্রেটিস, প্লেটো ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক অ্যারিস্টটলের আলোচনায় যে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সূচনা একবিংশতকে তার আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। তথাপি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের যথার্থ সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞার অভাব আজও বর্তমান। এস. এল. ওয়াসবি উল্লেখ করছেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কিত বিভ্রান্তি ও মতপার্থক্য এবং এর পরিবর্তনশীল প্রকৃতি অনিশ্চিত আলোচনার পটভূমি কোনো একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞাকে যথার্থ হতে দেয় নি।” জেলিনেকের মতে, সঠিক নামকরনের সমস্যা নিয়ে অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের তুলনায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধিক বিব্রত। বুৎপত্তিগত অর্থে গ্রিক শব্দ ‘পলিস’ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান শব্দটি এসেছে। ‘Polis এর ইংরেজী প্রতিশব্দ ‘পলিটিক্স’, যার অর্থ রাষ্ট্রনীতি। এদিক থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান হলো যা রাষ্ট্রকে নিয়ে আলোচনা করে।
তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা আলোচনা প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে রাষ্ট্রবিজ্ঞান কথাটি প্রথম প্রয়োগ দেখা যায় ১৭০১ সালে বিশপকে প্রদত্ত লিপনিজ কর্তৃক লিখিত চিঠিতে। পরবর্তীকালে বিভিন্ন লেখায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান শব্দটি ব্যবহৃত হলেও বর্তমানে সমাজ বিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শাখা হিসেবে যে অর্থে রাষ্ট্রবিজ্ঞান শব্দটি ব্যবহৃত হয় তা উনিশ শতকের পরবর্তী সময়ে গৃহীত হয়। লিপসেটের লেখা ‘দ্যা পলিটিক্যাল ম্যান’ নামক গ্রন্থে পাওয়া যায় যে ১৮৯০ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান কথাটি আধুনিক অর্থে আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থতালিকাতে প্রথম অন্তর্ভুক্ত হয়।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা আলোচনায় একাধিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর সংজ্ঞা
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা আলোচনায় একাধিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর সংজ্ঞা দেখা যায়। যেমন –
রাষ্ট্রভিত্তিক সংজ্ঞা :-
রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সংজ্ঞা প্রদানকারীদের মধ্যে ব্লুন্টসলি, গার্নার, গ্যারিস, জেলিনেক, গেটেল প্রমুখদের নাম উল্লেখযোগ্য। রাষ্ট্রদার্শনিক ব্লুন্টসলির মতে “রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল সমাজ বিজ্ঞানের সেই শাখা বা রাষ্ট্রের বিজ্ঞান।” অধ্যাপক গার্নার তাঁর ‘Political Science and Government’ গ্রন্থে উল্লেখ করছেন, “রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শুরু ও সমাপ্তি রাষ্ট্রকে নিয়ে।” গেটেলের মতানুযায়ী, “রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল রাষ্ট্র কী ছিল তার অতীত অনুসন্ধান, বর্তমানে কেমন অবস্থা সে সম্পর্কে বিশ্লেষণ এবং ভবিষ্যতে কেমন হওয়া উচিত সে সম্পর্কে একটি রাজনৈতিক নীতিধর্মী আলোচনা।”
সরকারভিত্তিক সংজ্ঞা :-
অনেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলতে সরকারের বিজ্ঞান বলে উল্লেখ করতে চেয়েছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন সিলি, ক্যাটলিন, লিকক প্রমুখ। সিলির মতে, “জীবনবিজ্ঞান যেমন জীবন নিয়ে, অর্থনীতি যেমন সম্পদ নিয়ে আলোচনা করে তেমনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রধান আলোচ্য বিষয় হওয়া উচিত সরকার।”
রাষ্ট্র ও সরকার ভিত্তিক সংজ্ঞা :-
পলজানে, গিলক্রিস্টের ন্যায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা দানে রাষ্ট্র ও সরকার উভয়কেই উল্লেখ করেছেন। পলজানে এই অভিমত পোষণ করেন যে, “রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল সমাজ বিজ্ঞানের সেই শাখা যা রাষ্ট্রের মৌলিক ভিত্তি ও সরকারের নীতি সমূহ নিয়ে আলোচনা করে।” অধ্যাপক গিলক্রিস্টের মতে, “রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্র ও সরকার নিয়ে আলোচনা করে।”
আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি :-
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের যারা রাষ্ট্রনিরপেক্ষ সংজ্ঞা দিতে চেয়েছেন তাঁদের মধ্যে ডেভিড ইস্টন, গ্রাহাম ওয়ালস, আর্থার বেন্টলে, ল্যাসওয়েল, বরাট ডাল, অ্যালান বল প্রমুখর নাম উল্লেখযোগ্য। লাসওয়েল উল্লেখ করেছেন, “রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল প্রভাব ও প্রভাবশালীদের আলোচনা”। অ্যালান বলের মতে, “রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল সেই বিষয় যা সমাজে বসবাসকারী মানুষের বিরোধ ও মীমাংসা নিয়ে আলোচনা করে।” ডেভিড ইস্টনের মতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল, “মূল্যের কর্তৃত্ব সম্পন্ন বরাদ্দের পাঠ।” অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে, “সংগঠিত রাষ্ট্রের পরিপ্রেক্ষিতে মানবজীবনের আলোচনাই রাষ্ট্রবিজ্ঞান”
মার্কসবাদী সংজ্ঞা :-
মার্কসবাদীরা সমাজের মূল চালিকা শক্তি হিসাবে উৎপাদন পদ্ধতি তথা অর্থনীতির কথা উল্লেখ করেন। তাই তাদের কাছে রাজনীতি হল উপরিকাঠামো, যা অর্থনৈতিক বুনিয়াদকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। মার্কস ও এঙ্গেলসের মতে সামাজিক প্রক্রিয়ার অন্যতম দিক হল রাজনীতি। ভি. আই. লেনিনের মতে, “রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল সকল শ্রেণীর সঙ্গে সরকার ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক এবং বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের আলোচনা।”
সর্বোপরি বলা যায় পরিবর্তনশীল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিবর্তন পরিধির পরিবর্তনশীলতায় ধারাবাহিকতা রেখেছে। নতুন নতুন ঘটনা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুকে করে চলেছে সমৃদ্ধ – এরূপ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা দেওয়া যেতে পারে যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল সমাজবিজ্ঞানের সেই শাখা যা বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনার মাধ্যমে রাষ্ট্রের তত্ত্ব, সাংগঠনিক ও প্রশাসনিক প্রসঙ্গ, অন্তর্জাতিক আইন ও প্রশাসন সহ বিভিন্ন প্রকার রাজনৈতিক ব্যবস্থার তুলনামূলক বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা ও পর্যালোচনা করে।