রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের একত্ববাদ তত্ত্ব – সম্পর্কে অস্টিন-এর মতবাদ

রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের একত্ববাদ তত্ত্ব আলোচনা করো। সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে অস্টিন-এর মতবাদ বর্ণনা কর। অথবা, সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে পরম্পরাগত মতবাদ বা একত্ববাদ আলোচনা করো। এই তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা কী কী?- রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব 

রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের একত্ববাদ তত্ত্ব – সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে অস্টিন-এর মতবাদ বর্ণনা কর। অথবা, সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে পরম্পরাগত মতবাদ বা একত্ববাদ আলোচনা – এই তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা কী কী?

  • রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের একত্ববাদ তত্ত্ব আলোচনা করো। সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে অস্টিন-এর মতবাদ বর্ণনা কর।
  • অথবা, সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে পরম্পরাগত মতবাদ বা একত্ববাদ আলোচনা করো। এই তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা কী কী?

একাত্ববাদ :- সার্বভৌমত্বের চরম, অবাধ, অসীম ও অবিভাজ্য আইনগত অর্থটি পরম্পরাগত মতবাদ বলে পরিচিত। একত্ববাদের দুটি দিক কল্পনা করা যায় – পূর্ণ তত্ত্বগত এবং বাস্তব। প্রথম অর্থ অনুযায়ী রাষ্ট্র হল এক এবং অদ্বিতীয় সংগঠন। দ্বিতীয় অর্থ অনুযায়ী একত্ববাদ সংঘের অস্তিত্ব স্বীকার করে, কিন্তু সংঘগুলি সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন বলে স্বীকার করা হয়। এই দুই অর্থে সার্বভৌমত্বের আইনগত ব্যাখ্যাকেই পরম্পরাগত মতবাদীরা একত্ববাদ বা অস্টিনের মতবাদ বলে প্রচার করে থাকেন। বোঁদা, হবস, বেন্থাম এবং অস্টিনই হলেন একত্ববাদের প্রধান প্রবক্তা।

আইনগত সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে ধারণা ইংরেজ আইনবিদ জন অস্টিনের রচনায় পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৩২ সালে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত ‘Lectures on Jurisprudence’ গ্রন্থে অস্টিন আইনগত সার্বভৌমত্বের স্বরূপ বিস্তৃতভাবে আলোচনা করেন। সার্বভৌমত্বের একত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি হবস এবং বেন্থাম-এর রচনায় প্রকাশিত হয়েছিল। অস্টিন, হবস ও বেন্থামের ধারণাকে গ্রহণ করলে তাঁর তত্ত্ব সার্বভৌমত্বের যুক্তিযুক্ত, বাস্তব এবং বিশ্লেষণাত্মক ব্যাখ্যা বলে অভিহিত করা যায়। বোঁদা, হবস, বেন্থাম ও অস্টিনের মতবাদ একত্ববাদ হিসেবে পরিচিত।

অস্টিনের সংজ্ঞা বিশ্লেষণ :- জন অস্টিন ছিলেন আইনবিদ এবং আইনের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করতে তিনি সার্বভৌমত্বেরও প্রকৃতি বিচার করেছেন। অস্টিনের মতানুযায়ী সার্বভৌমত্বের প্রকৃতি হল অধস্তনের প্রতি ঊর্ধ্বতন বা উচ্চতর কর্তৃপক্ষের আদেশ। উচ্চতর কর্তৃপক্ষের আদেশ অধস্তনের স্বাভাবিক ও অভ্যাসগত আনুগত্যের জন্য স্বতই কার্যকর। উচ্চতর কর্তৃপক্ষের আদেশের পিছনে চরম কর্তৃত্বের অসীম শক্তি বর্তমান, যা অধস্তন ব্যক্তিরা অমান্য করতে সাহস করে না। অস্টিন বলেন, “যখন কোনো সমাজে নির্দিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ – কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আনুগত্য স্বীকার না করে সেই সমাজের অধিকাংশের স্বভাবজাত আনুগত্য লাভ করে, তা হলে সেই ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সেই সমাজে সার্বভৌম এবং সার্বভৌমত্ব সহ সেই সমাজ “রাজনৈতিক ও স্বাধীন সমাজ। “

অস্টিনের সংজ্ঞার বৈশিষ্ট্য :- জন অস্টিনের সংজ্ঞাটি বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন – 

(১) প্রতিটি রাজনৈতিক সমাজে এমন একটি মানবীয় কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ, ব্যক্তি বা গোষ্ঠী থাকে যা রাষ্ট্রের চরম ক্ষমতা ব্যবহার করে। 

(২) এই ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সুনির্দিষ্ট, এদের অস্তিত্ব সম্পর্কে কোনোরকম ভুল বুঝবার সম্ভাবনা নেই।

(৩) এই ব্যক্তি বা গোষ্ঠী রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বা বাইরে অপর কারও কাছে অনুগত্য প্রকাশ করে না। 

(৪) এই কর্তৃপক্ষ জনগণের অধিকাংশর কাছে অভ্যাসগত আনুগত্য লাভ করে থাকে। 

(৫) রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সকল ব্যক্তি বা সংস্থার ওপর এই ক্ষমতা চরমভাবে প্রযোজ্য। এই ক্ষমতা অসীম ও অবিভাজ্য।

সুতরাং অস্টিনের মতে, সার্বভৌমত্ব হল রাষ্ট্রের চরম, অপ্রতিহত, অসীম ক্ষমতা, যা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ব্যবহার করে। আইন হল সার্বভৌমের আদেশ (“Law is the command of the sovereign.”)। সার্বভৌমের আদেশ বা আইন মানতে সমাজের সকলেই বাধ্য। 

একাত্ববাদের সমালোচনা :- একাত্ববাদী তত্ত্বের দুর্বলতা সমালোচকদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় নি। একাত্ববাদীদের ত্রুটিগুলি হল –

প্রথমত, এই মতবাদ অনুযায়ী একমাত্র রাষ্ট্রের হাতে সার্বভৌমিকতা থাকে যা বহুত্ববাদীরা সমালোচনা করে বলেন এই ক্ষমতা সমাজের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও ভোগ করে। 

দ্বিতীয়ত, একাত্ববাদীরা রাষ্ট্র ও সমাজকে অভিন্ন বলে ব্যাখ্যা করে। কিন্তু বহুত্ববাদীরা, বিশেষ করে ল্যাস্কির উল্লেখ করেন রাষ্ট্র সংঘমূলক।

তৃতীয়ত, একাত্ববাদীরা রাষ্ট্রের ক্ষমতার সার্বিক ব্যাপ্তির কথা বলে। কিন্তু বহুত্ববাদীদের মতে রাষ্ট্র ব্যক্তির জীবনে কেবল বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। 

চতুর্থত, একাত্ববাদীরা আইনকে সার্বভৌমের নির্দেশ বলে উল্লেখ করেন যা বহুত্ববাদীরা গ্রহণ করে না।

পঞ্চমত, একাত্ববাদীরা সর্বশক্তিমান ও অনিয়ন্ত্রিত সার্বভৌম রাষ্ট্রের কথা বলেন। কিন্তু বহুত্ববাদীরা তা নস্যাৎ করে বলেন বর্তমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় কোনো রাষ্ট্র স্বয়ং সম্পূর্ণ নয়। 

তবে উপসংহারে বলা যায় দুর্বলতা সত্ত্বেও সার্বভৌমিকতার একাত্ববাদী তত্ত্বের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সার্বভৌমিকতা নিরঙ্কুশ একাধিপত্যের অবসান ঘটলে জাতিরাষ্ট্রের ধারণার উদ্ভবলগ্নে ইহার গুরুত্ব ছিল তাৎপর্যপূর্ণ।

Leave a Comment