সার্বভৌমত্বের সংজ্ঞা – বৈশিষ্ট্য কী কী?

সার্বভৌমত্বের সংজ্ঞা নির্দেশ করো। এর বৈশিষ্ট্য কী কী? –রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব 

সার্বভৌমত্বের সংজ্ঞা নির্দেশ করো। এর বৈশিষ্ট্য কী কী?

সার্বভৌমত্বের সংজ্ঞা :-

সার্বভৌমত্বের ধারণাই আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভিত্তি। অর্থশাস্ত্রে মূল্যতত্ত্বের গুরুত্ব যেমন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সার্বভৌমত্ব তেমনি গুরুত্বপূর্ণ। লাতিন শব্দ Superarus থেকে ইংরেজি ‘Sovereignty’ (সার্বভৌমত্ব) শব্দের উদ্ভব হয়েছে। শব্দগত অর্থে Superanus বলতে বোঝায় চরমত্ব বা সর্বশ্রেষ্ঠত্ব। সুতরাং, সার্বভৌমত্ব থেকে রাষ্ট্রের অসীম, অনিয়ন্ত্রিত ও চরম ক্ষমতা বোঝায়। অবশ্য বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সার্বভৌমত্বের বিভিন্ন সংজ্ঞা নির্দেশ করেছেন। 

ফরাসি লেখক বোঁদা-র মতে, আইন দ্বারা অনিয়ন্ত্রিত, সকল প্রজা ও নাগরিকের ওপর প্রযুক্ত হবার চরম ক্ষমতাই হল সার্বভৌমত্ব। 

উইলোবির ভাষায়,

“সার্বভৌমত্ব হল রাষ্ট্রের চরম ইচ্ছার প্রকাশ”

(“Sovereignty is the supreme will of the State.”)

উইলোবি

ইংরেজ অধ্যাপক বার্কার সার্বভৌমত্ব চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবার অধিকার সমন্বিত রাষ্ট্র-কর্তৃত্ব বলে অভিহিত করেছেন। 

আধুনিককালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক র‍্যাফেল বলেছেন যে, কোনো রাষ্ট্র সার্বভৌম – এই কথা বলবার অর্থ হল নির্দিষ্ট সমাজে রাষ্ট্রের চরম বা চূড়ান্ত কর্তৃত্ব রয়েছে এবং এর আইন সমাজের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের নিয়মকানুনের ঊর্ধ্বে।

বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা যায় রাষ্ট্রের আইনগত চূড়ান্ত ও অবাধ ক্ষমতাই হল সার্বভৌমত্ব। সার্বভৌমত্বের দুটি দিক – অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক। অভ্যন্তরীণ দিক থেকে রাষ্ট্রাধীন সকল ব্যক্তি ও সংঘের ওপর আইন বলবৎ করবার চরম ক্ষমতা বোঝায়। এই সকল ব্যক্তি ও সংঘের প্রতি নির্দেশ দান করতে পারে, কিন্তু কারো কাছ থেকে নির্দেশ লাভ করে না। সুতরাং, অভ্যন্তরীণ দিক থেকে বিভিন্ন আইনগত দ্বন্দ্বের চূড়ান্ত মীমাংসা করবার ও ব্যক্তিসংঘের ওপর প্রযোজ্য কর্তৃত্বের চরম ক্ষমতাই হল সার্বভৌমত্ব। 

বাহ্যিক সার্বভৌমত্বের’ অর্থ হল, রাষ্ট্র অন্য কোনো রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ মুক্ত হয়ে আপন নীতি ও কর্মধারা স্থির করতে সম্পূর্ণভাবে সক্ষম। বহিঃশক্তির নিয়ন্ত্রণমুক্ত না হলে অর্থাৎ, স্বাধীন না হলে অভ্যন্তরীণ চরম ক্ষমতা রাষ্ট্রের পক্ষে প্রয়োগ করা সম্ভব হবে না। বাহ্যিক সার্বভৌমত্বকে সে কারণে অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ‘স্বাধীনতা’ বলেছেন। অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্বকে কার্যকর করবার জন্যই স্বাধীনতা বা বাহ্যিক সার্বভৌমত্বের প্রয়োজন।

সার্বভৌমত্বের বৈশিষ্ট্য :-

সার্বভৌমত্বের সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলি পরিলক্ষিত হয় –

(১) মৌলিকত্ব ও চরমত্ব :-

সার্বভৌম হল আইনপ্রণয়নের চরম ক্ষমতা। কোনো কিছুর দ্বারা এই ক্ষমতা সীমাবদ্ধ হতে পারে না। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে এমন কোনো সংঘ বা প্রতিষ্ঠান থাকতে পারে না, যার কাছে রাষ্ট্রকে নতিস্বীকার করতে হয়। সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে ধারণাটি সম্পূর্ণ আইনগত। সুতরাং, নৈতিক নিয়মের দ্বারা সার্বভৌমত্বের সীমারেখা টানা সম্ভব হয় না। আন্তর্জাতিক আইনের দ্বারাও সার্বভৌমত্ব সীমাবদ্ধ হতে পারে না।

(২) স্থায়িত্ব :-

সার্বভৌমত্বের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল স্থায়িত্ব। যতদিন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব থাকবে, ততদিন সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ থাকবে। রাষ্ট্রের বিলুপ্তি না ঘটলে সার্বভৌমত্বের বিনাশ নেই। সরকার বা শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সার্বভৌমত্বের কোনো সম্পর্ক নেই। সরকারের পরিবর্তনে রাষ্ট্রের ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ণ হয় না। সুতরাং, রাষ্ট্রের অস্তিত্বের সঙ্গে সার্বভৌমত্ব বজায় থাকবে।

(৩) সর্বজনীনতা বা সর্বব্যাপকতা :-

সার্বভৌমত্বের আর একটি বৈশিষ্ট্য হল এর সর্বজনীনতা। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সকল ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ওপর সার্বভৌমত্ব চূড়ান্তভাবে প্রযোজ্য। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সার্বভৌম ক্ষমতার হাত থেকে অব্যাহতি লাভ করতে পারে না। অর্থাৎ, নির্দিষ্ট সমাজে এমন কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থাকতে পারে না, যার ওপর প্রয়োজন হলে রাষ্ট্র নিজ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে না। সার্বভৌমত্বের সর্বজনীনতার একমাত্র ব্যতিক্রম হিসেবে বিদেশি রাষ্ট্রে কুটনৈতিক প্রতিনিধিদের ভৌম-এলাকা বহির্ভূত সুযোগ-সুবিধার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।

(৪) অবিভাজ্যতা :-

সার্বভৌমত্বের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসাবে এর অবিভাজ্যতার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। সার্বভৌমত্ব এক এবং অবিভাজ্য। ঐক্যবদ্ধ জনসমাজের চূড়ান্ত ক্ষমতা একটি কেন্দ্রীয় সংস্থার হাতেই ন্যস্ত। রাষ্ট্রাধীন বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে ক্ষমতার বণ্টন সম্ভব হতে পারে কিন্তু চূড়ান্ত কর্তৃত্ব বা সার্বভৌমত্ব বণ্টন সম্ভব নয়।

(৫) হস্তান্তর অযোগ্যতা :-

সার্বভৌম ক্ষমতার ইচ্ছামত হস্তান্তর করা সম্ভব নয়। চূড়ান্ত ও অসীম ক্ষমতা কখনও হস্তান্তর করা যায় না। ব্যক্তি যেমন তার জীবন হস্তান্তর করে বাঁচতে পারে না, বৃক্ষ বৃদ্ধির অধিকার ত্যাগ করে বাঁচতে পারে না, তেমনি সার্বভৌম ক্ষমতা হস্তান্তর করে রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না। যুদ্ধবিগ্রহের ফলে কোনো সন্ধি বা চুক্তির শর্ত পালন করবার জন্য যদি রাষ্ট্র তার ভূ-খণ্ডের কোনো অংশ হস্তান্তর করে তার দ্বারা সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ হয় না।

মার্কসবাদ অনুযায়ী সার্বভৌমত্বের বৈশিষ্ট্য

সবশেষে মার্কসবাদ অনুযায়ী সার্বভৌমত্বের বৈশিষ্ট্যের কথা বলা যায়। মার্কসবাদ অনুসারে,

  • (১) সার্বভৌমত্ব হল শ্রেণিক্ষমতা বা শ্রেণি-সার্বভৌমত্ব। শ্রেণিবিভক্ত সমাজে আর্থিক দিক থেকে প্রতিপত্তিশালী শ্রেণি এটাকে শ্রেণি-স্বার্থে ব্যবহার করে।
  • (২) সার্বভৌমত্বের ভিত্তি হল চরম বলপ্রয়োগমূলক শক্তি, আইন ও শ্রেণি-স্বার্থের প্রকাশ।
  • (৩) জনকল্যাণ, শান্তি-শৃঙ্খলা প্রভৃতির নামে শাসকশ্রেণি জনগণের আনুগত্য আদায়ের চেষ্টা করে।
  • (৪) সার্বভৌমত্ব বিভাজ্য বা বিচ্ছিন্ন নয়, এটা শাসকশ্রেণির চরম কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা।
  • (৫) সমাজে শ্রেণিদ্বন্দ্ব তীব্রতর হয়ে উঠলে সার্বভৌমত্বের ভিত্তি হিসাবে চরম নগ্ন দমনমূলক ক্ষমতার প্রকাশ ঘটে।

Leave a Comment