মৌলিক ধারণা– স্বাধীনতার সংজ্ঞা দাও। স্বাধীনতার প্রকৃতি ব্যাখ্যা কর।
স্বাধীনতার সংজ্ঞা দাও- স্বাধীনতার প্রকৃতি ব্যাখ্যা কর।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চায় স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রী – এই তিনটি আদর্শ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্যতম ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। তিনটি আদর্শের মধ্যে চিন্তাবিদ মন্টেস্কুর মতে, “স্বাধীনতার ন্যায় অন্য কোনো ধারনা এরূপ বিচিত্র তাৎপর্য বহন করে নি এবং মানুষের মনে এত ভিন্নমুখী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে নি।”
স্বাধীনতার অর্থ
ইংরাজীতে ‘Liberty’ শব্দটির বাংলাগত অর্থ ‘স্বাধীনতা’। ‘Liberty’ কথাটি এসেছে লাতিন ‘Liber’ থেকে, যার অর্থ মুক্ত থাকা বা মুক্ত হওয়া। ‘স্বাধীনতা’ জাতীয় মুক্তি অর্থে ব্যবহৃত হয়। তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ‘Liberty’ ‘স্বাধীনতা’ বলতে ব্যক্তি স্বাধীনতা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। বুৎপত্তিগত অর্থে ‘স্বাধীনতা’ বলতে নিয়ন্ত্রবিহীনতা তথা স্ব-অধিনতা তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্বাধীনতা অবাধ বা নিয়ন্ত্রণবিহীন নয়।
স্বাধীনতার সংজ্ঞা
এরূপ পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যায় বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে স্বাধীনতার সংজ্ঞা আলোচনা করেছেন। অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে “স্বাধীনতা হল ব্যক্তির আত্মবিকাশের সুযোগের পরিবেশ।” তিনি আরো বলেন, “স্বাধীনতা হল অধিকারের ফল”।
রুশো, হেগেল প্রমুখরা স্বাধীনতাকে ইতিবাচক অর্থে ব্যখ্যা করেন। রুশোর মতে ‘সাধারণের ইচ্ছা’র মধ্যে ব্যক্তির স্বাধীনতা বাস্তবায়িত হয়। আবার হেগেল উল্লেখ করেছেন রাষ্ট্রের ইচ্ছার মধ্যেই ব্যক্তি স্বাধীনতার পূর্ণ বিকাশ ঘটে।
অন্যদিকে জেরেমি বেন্থাম, জেমস স্টুয়ার্ট মিল, হেনরি সিজউইক প্রমুখরা নেতিবাচক অর্থে স্বাধীনতার ধারণাকে গ্রহণ করেন। তাঁরা স্বাধীনতা অর্থে ব্যক্তি জীবনের উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণহীনতার কথা ব্যাখ্যা করেন। জন স্টুয়ার্ট মিলের মতে, “স্বাধীনতা হল ব্যক্তি চিন্তাধারার অব্যাহত প্রকাশ”।
অনেকে আবার আইনগত ধারণায় স্বাধীনতার ব্যাখ্যা করেন। তাদের মতে অধিকারের ন্যায় স্বাধীনতাও আইনগত ধারণা ও রাষ্ট্রের মধ্যে ভোগ করা যায়। বার্কার উল্লেখ করেন, “রাষ্ট্রের মধ্যে স্বাধীনতা বা আইনসংগত স্বাধীনতা কখনোই প্রত্যেকের অবাধ, স্বাধীনতা হতে পারে না, ইহা সকল ক্ষেত্রে শর্তসাপেক্ষ স্বাধীনতা। অন্যান্যদের মধ্যে রাষ্ট্র বিজ্ঞানী সিলী উল্লেখ করেন, “স্বাধীনতা হল অতি শাসনের বিপরীত অবস্থা”।
মার্কসবাদীরা বস্তুবাদী ব্যাখ্যার দ্বারা শ্রেণীগত দৃষ্টিভঙ্গিতে স্বাধীনতা আলোচনা করেন। কার্ল মার্কসের নিকট আত্মনিয়ন্ত্রণ হল স্বাধীনতা। মার্কস উল্লেখ করেছেন, “স্বাধীনতার অর্থ প্রকৃতিক শক্তির উপর এবং মানুষের নিজের প্রকৃতির উপর আত্ম-প্রভুত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ”। তবে পুজিঁবাদী সমাজের স্বাধীনতা সংখ্যালঘিষ্ট মালিক, যারা উৎপাদনের উপকরণসূহকে নিয়ন্ত্রণ করে তাদের স্বাধীনতা।
স্বাধীনতার প্রকৃতি
প্রাচীন গ্রীসে ও এথেন্সে উদ্ভুত স্বাধীনতার ধারণাটি মানবসমাজের পরিবর্তনের সাথে সাথে ভিন্ন প্রকৃতি ধারণ করেছে। দাস ব্যবস্থায় ক্রীতদাসদের স্বাধীনতা ছিল না আবার সামন্ততান্ত্রিক যুগে দীর্ঘকাল ব্যক্তির স্বাধীনতা গুরুত্ব না পেয়ে ধর্ম বা ঈশ্বর সম্পর্কিত আলোচনা গরুত্ব পায়। অবশ্য নবজাগরণের পর মানবতাবাদি ধারনার প্রকাশ স্বাধীনতার ধারণায় যুগান্তকারী পরিবর্তণ আনে। এরূপ প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতার প্রকৃতি আলোচনায় বলা যায় সাধারণত দুটি অর্থে স্বাধীনতার নীতি ব্যবহৃত হয় – ইতিবাচক দিক ও নেতিবাচক দিক।
ইতিবাচক অর্থে স্বাধীনতা অর্থে স্ব শাসন ও স্বনিয়ন্ত্রণের উপর গুরুত্ব আরোপিত হয়। এই ধারণার সমর্থকদের মধ্যে রুশো, হেগেল, গ্রিন, ল্যাস্কি প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। রুশোর মতে ‘সাধারনের ইচ্ছা’ গঠিত হয় সকল মানুষের ‘প্রকৃত ইচ্ছা’ এর সমন্বয়ে। আর এই সাধারণের ইচ্ছার মধ্যে বক্তি স্বাধীনতা বাস্তবায়িত হয়ে উঠবে। হেগেলের বক্তব্য ছিল রাষ্ট্রীয় আইনের মাধ্যমেই ব্যক্তির স্বাধীনতা বাস্তবায়িত হয়। ভাববাদী দার্শনিক গ্রিনের নিকট ব্যক্তির ইচ্ছা বা স্বাধীনতা তাঁর সদিচ্ছা ও নৈতিকতার সার্বিক বিকাশ ঘটায়। ল্যাস্কির নিকট স্বাধীনতা ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের আবশ্যকীয় সুযোগ সুবিধা।
অন্য দিকে নেতিবাচক অর্থে স্বাধীনতা বলতে বোঝায় ব্যক্তি জীবনে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণহীনতা। বেন্থাম, স্পেনসার, হবস, লক, স্মিথ, জেসম মিল, জন স্টুয়ার্ট মিল প্রমুখরা ব্যাখ্যা করেন স্বাধীনতা হল সর্বপ্রকারের বাধা নিষেধের অনুপস্থিতি। আবার ম্যাকক্যালাস নামে অপর চিন্তাবিদ স্বাধীনতার প্রকৃতি ব্যাখ্যায় উপরিউক্ত দুটি অর্থ গ্রহণ না করে মূলত তিনটি উপাদানের কথা বলেন। এই তিনটি ধারণা হল – ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যাদের স্বাধীনতার কথা বলা হচ্ছে, কোনো কিছু বাধা বা নিয়ন্ত্রণ থেকে স্বাধীনতার কথা বল হয় এবং কোনো কিছু করা বা না করা, হওয়া বা না হওয়ার উদ্দেশ্যে স্বাধীনতার কথা বলা হয়।
মার্কসবাদী দৃষ্টিতে উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ধনতন্ত্র স্বাভাবিক রূপ। এক্ষেত্রে মুষ্টিমেয় ধনিক শ্রেণীর শাসন স্বাধীনতার অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই সমাজ ব্যবস্থার রূপান্তরের মাধ্যমে উৎপাদনের উপকরণের উপর রাষ্ট্রীয় মালিকানায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং শোষণের বাসনা সাধন করতে হবে তবে ব্যক্তির স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হবে।
সর্বোপরি বলা যায় স্বাধীনতার প্রকৃতি নির্ভর করে সমাজব্যবস্থার উপর। আদিম সাম্যবাদী সমাজে সামাজিক অর্থে স্বাধীনতার প্রয়োজন ছিল না। দাস সমাজে ক্রীতদাসদের কোনো স্বাধীনতা ছিল না এই সমাজে স্বাধীনতা ছিল দাস মালিকদের। আবার সামন্ততান্ত্রিক সময়ে সামন্ত প্রভুরা এই স্বাধীনতা ভোগ করত। তবে সামন্তরা দাসদের তুলনায় কিছু স্বাধীনতা ভোগ করত বিশেষ করে পরিবার গঠন ও সন্তান প্রজনন করার স্বাধীনতা। ধনতান্ত্রিক সমাজে রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা থাকলেও প্রচ্ছন্নভাবে উৎপাদিকা শক্তির মালিক শ্রেণীর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। অবশ্য সমাজতান্ত্রিক সমাজে যেহেতু উৎপাদনের উপকরণের উপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয় তাই স্বাধীনতার পূর্ণতা বা যথার্থ বাস্তবায়ন ঘটে। এভাবে দেখা যায় সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে স্বাধীনতার সম্প্রসারণ ঘটেছে।